ইসরায়েলের হামলায় গাজার হাসপাতালগুলোর অবস্থা ‘অবর্ণনীয়’: ডব্লিউএইচও

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) বলেছে, গাজার হাসপাতালগুলোর অবস্থা বর্ণনাতীত। ফিলিস্তিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে ইসরায়েলের বিমান হামলার পর এ মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। খবর বিবিসি-এর।
ডাব্লিউএইচও-এর মুখপাত্র ড. মার্গারেট হ্যারিস বিবিসিকে বলেন, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর একের পর এক হামলা হচ্ছে এবং ইসরায়েলের অবরোধের কারণে চিকিৎসাসামগ্রীর চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
গত রোববার গাজার আল-আহলি হাসপাতালের কর্মীরা জানান, ইসরায়েলি হামলায় হাসপাতালের ল্যাব ধ্বংস হয়ে গেছে এবং জরুরি বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও এই হামলায় সরাসরি কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তারা জানান, চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হওয়ায় এক শিশু মারা গেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা হামাসের একটি 'কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার'-এ আঘাত হেনেছে, যেখান থেকে হামলার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল।
আল-আহলি হাসপাতালটি পরিচালনার দায়িত্বে আছে চার্চ অব ইংল্যান্ড। এই হামলার ঘটনায় চার্চ অব ইংল্যান্ডের বিশপরা শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং ভোগান্তির শিকার ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন। ইসরায়েলের কাছে হামাস ওই এলাকায় অবস্থান করছিল—এই দাবি প্রমাণের জন্য যেন ইসরায়েল উপযুক্ত তথ্য উপস্থাপনের দাবিও জানান তারা।
এদিকে, গাজায় অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর চার সপ্তাহ কেটে গেছে। ইসরায়েল আকাশ ও স্থলপথে হামলা থেমে নেই। ইসরায়েল বলছে, হামাস যাতে বাকি জিম্মিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়, সে জন্য তারা সামরিক চাপ প্রয়োগ করছে।
রোববার রাতের দিকে, প্রায় মধ্যরাতে আল-আহলি হাসপাতালে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে।
জেরুজালেমের অ্যাংলিকান ডায়োসিসের (ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ) তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালের দু'তলা বিশিষ্ট জেনেটিক ল্যাবরেটরিটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ফার্মেসি ও জরুরি বিভাগের ভবনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশপাশের অন্যান্য ভবনও ক্ষতির শিকার হয়েছে, যার মধ্যে সেন্ট ফিলিপ চার্চও রয়েছে।
ডায়োসিস জানায়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হামলার আগে হাসপাতালের কর্মী ও রোগীদের সরে যেতে মাত্র ২০ মিনিট সময় দিয়েছিল।
হামলায় সরাসরি কোনো প্রাণহানি ঘটেনি, তবে আগেই মাথায় আঘাত পাওয়া এক শিশু হঠাৎ করে দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করেছে বলে জানানো হয়।
পরে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. টেড্রোস অ্যাধানম গেব্রেয়াসুস বলেন, আল-আহলি হাসপাতালের পরিচালক সংস্থাটিকে জানিয়েছেন যে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, ল্যাবরেটরি, জরুরি বিভাগের এক্স-রে যন্ত্রপাতি এবং ফার্মেসি 'ধ্বংস' হয়ে গেছে।
তিনি আরও জানান, হাসপাতালটি ৫০ জন রোগীকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু গুরুতর অবস্থায় থাকা ৪০ জন রোগীকে সরানো সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, "হাসপাতালগুলো আন্তর্জাতিক মানবিক আইন দ্বারা সুরক্ষিত। স্বাস্থ্যসেবার ওপর হামলা বন্ধ হওয়া উচিত। আমরা আবারও বলছি, রোগী, স্বাস্থ্যকর্মী এবং হাসপাতালগুলো সুরক্ষিত হতে হবে।"
এদিকে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, "একটি ভবনে হামলা করা হয়েছে। ভবনটি 'হামাসের কন্ট্রোল সেন্টার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল' এবং এখানে কোনো চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল না।"
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, তারা একটি 'প্রারম্ভিক সতর্কতা' জারি করেছিল। এছাড়া হাসপাতাল এলাকার ক্ষতি এড়িয়ে হামলাটি চালানো হয়েছে। অংশটি চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য কার্যকর ছিল।
হামাস এই হামলাকে 'অবর্ণনীয় অপরাধ' হিসেবে নিন্দা করেছে এবং দাবি করেছে যে তারা ওই স্থাপনাটি সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছিল না।
সোমবার, ইংল্যান্ডের চার্চ অব ইংল্যান্ডের বিশপদের হাউস এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা গাজায় হাসপাতালগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হওয়ায় 'শোকাহত' এবং ইসরায়েল এখনও হাসপাতালটি হামাস দ্বারা ব্যবহৃত হওয়ার দাবির পক্ষে স্পষ্ট ও যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।
এই পরিস্থিতিতে, চার্চ অব ইংল্যান্ড আক্রমণ এবং হাসপাতালের অপব্যবহারের অভিযোগের বিষয়টি স্বাধীন, পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
বিশপরা আরও বলেছেন, হাসপাতাল থেকে কর্মী ও রোগীদের সরে যেতে অত্যন্ত সীমিত সময় দেওয়া হয়েছিল। এটি মৌলিক মানবাধিকার এবং মানব মর্যাদার ওপর আরও একটি আঘাত।
এদিকে ডাব্লিউএইচও-এর প্রতিনিধি ড. রিক পিপারকর্ন বিবিসিকে জানান, আল-আহলি হাসপাতাল এখন নতুন রোগী গ্রহণ করতে পারছে না। কারণ এটি মেরামতের অপেক্ষায় রয়েছে এবং এই ট্রমা রোগীদের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে।
ড. রিক পিপারকর্ন বলেন, আল-আহলি ছিল ওয়াদি গাজার উত্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রমা হাসপাতাল। এটি ছিল ওয়াদি গাজার উত্তরে একমাত্র কার্যক্ষম সিটি স্ক্যানারযুক্ত হাসপাতাল, যেখানে গুরুতর আঘাত বা অবস্থার জন্য সঠিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সিটি স্ক্যানারটি ব্যবহার করা যেত।
প্যালেস্টিনিয়ান মেডিকেল এইড নামে একটি দাতব্য সংস্থা আল-আহলির একজন অর্থোপেডিক সার্জনের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা গ্রহণকারী ৪০ জন অবশিষ্ট রোগীকে হাসপাতালটি এখন যথাযথ চিকিৎসা দিতে পারছে না। এর অবস্থা এখন একটি হোস্টেলের মতো।
ড. আহমেদ আল-শুওরাফা বলেন, "আমরা এখন আর কোনো সার্জারি করতে পারছি না, কারণ এই রোগীদের ল্যাবরেটরি ডায়াগনস্টিকস, ফার্মেসি সাপোর্ট এবং জটিলতা দেখা দিলে প্রয়োজনীয় সব সেবাই এখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।"
ড. মার্গারেট হ্যারিস সতর্ক করেছেন, "আমরা হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স কর্মী—এই সমস্ত মানুষের ওপর একের পর এক হামলা দেখতে পাচ্ছি... তারা জীবন বাঁচানোর জন্য নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু তারা নিজেদের জীবন হারাতে কাজ করেন না।"
২৩ মার্চ ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী খান ইউনিস শহরের নাসের হাসপাতালের সার্জিক্যাল বিভাগ লক্ষ্য করে হামলা চালায়, যার ফলে হামাসের অর্থনৈতিক প্রধান ইসমাইল বারহুম এবং আরও এক ব্যক্তি নিহত হন।
হামাস বলছে, বারহুম আগেই ইসরায়েলি হামলায় আঘাত পেয়ে সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তবে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এই দাবি অস্বীকার করে জানায়, তিনি হাসপাতালে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছিলেন।
ওই একই দিনে, ১৫ জন জরুরি সেবা কর্মী নিহত হন। তাদের মধ্যে আটজন ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট প্যারামেডিকও ছিলেন। তারা আহত মানুষের খবর পেয়ে রাফাহ শহরে চিকিৎসা সেবা দিতে সেখানে এসেছিলেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, ইসরায়েলি সেনারা হুমকির আশঙ্কা থেকে গুলি চালিয়েছিল। তাদের দাবি নিহতদের মধ্যে ছয়জন হামাস সন্ত্রাসী ছিলেন। তবে তারা তাদের দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ দেয়নি। রেড ক্রিসেন্ট এই অভিযোগ অস্বীকার করে, ইসরায়েলকে "একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধাপরাধী" বলে অভিযোগ করেছে।
সোমবার আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি জানায়, হামলার সময় একজন প্যারামেডিক নিখোঁজ ছিলেন। তাকে ইসরায়েলের কোথাও আটক করে রাখা হয়েছে।
গাজায় আইসিআরসি-র সাব-ডেলিগেশন প্রধান আদ্রিয়ান জিমারম্যান সতর্ক করে বলেন, চিকিৎসা সেবার অভাব গাজাবাসীর জীবন ও স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
ড. পিপারকর্ন বলেন, তারা চরমভাবে চিকিৎসা সরবরাহের অভাবে ভুগছে, কারণ ইসরায়েল গত ছয় সপ্তাহ ধরে কোন মানবিক সাহায্যের চালান গাজায় প্রবেশ করতে দেয়নি।
তিনি আরও বলেন, ডাব্লিউএইচও সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির সময়ে তার গুদামে কিছু সরবরাহ জমা করেছিল, তবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজার উত্তরের এবং দক্ষিণের মধ্যে সরবরাহের আদান-প্রদান সহজতর করতে সাহায্য করছে না।
তিনি আরও বলেন, "গত সপ্তাহে, আমরা আল-আহলির একজন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করেছিলাম। তিনি আমাদের জানান যে, তাদের বিভিন্ন অপারেশনের জন্য একই সার্জিক্যাল গাউন এবং গ্লাভস ব্যবহার করতে হয়েছে, তবে আমাদের ডেইর আল-বালাহ [ওয়াদি গাজার দক্ষিণে] গুদামে সার্জিক্যাল গ্লাভস এবং গাউন রয়েছে। আমরা সেগুলো নিয়ে আসতে চাই, কিন্তু আমাদের সাহায্য করা হচ্ছে না।"
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার প্রতিবাদে তাদের ধ্বংস করতে সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল সামরিক বাহিনী। এ ঘটনায় প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু ও ২৫১ জনকে আটক করা হয়েছিল।
হামাস-চালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, এ হামলায় গাজায় ৫০ হাজার ৯৮০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
জানুয়ারিতে একটি যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হয়েছিল। দুই মাস ধরে চলা এ যুদ্ধবিরতির সময় হামাস ৩৩ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেয়। এর মধ্যে এক হাজার ৯০০ ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে ৫ জন থাই জিম্মিকেও মুক্তি দেওয়া হয়।
ইসরায়েল ১৮ মার্চ হামাসের বিরুদ্ধে পুনরায় আক্রমণ শুরু করে। ইসরায়েল অভিযোগ করেছে, হামাস চুক্তির প্রথম পর্বের বিশেষ সময়সীমা বৃদ্ধি এবং তাদের আরও ৫৯ জিম্মির মধ্যে আরও কয়েকজনকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব মেনে নেয়নি, যাদের মধ্যে ২৪ জন এখনও জীবিত বলে বিশ্বাস করে তারা।
হামাসও ইসরায়েলকে মূল চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।
সোমবার হামাস এর একটি প্রতিনিধি দল কায়রো ত্যাগ করেছে এবং মিশরীয় মধ্যস্থতাকারীদের সাথে নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি, বলে একজন উচ্চপদস্থ ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বিবিসি-কে জানান।
ওই কর্মকর্তা বলেন, "ইসরায়েলের যুদ্ধ শেষ করতে এবং গাজা উপত্যকা থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাখ্যান করার কারণে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি।"
তিনি দাবি করেন, "হামাস নমনীয়তা দেখিয়েছে, অগ্রগতির জন্য জিম্মিদের মুক্তি দিতে চেয়েছে। কিন্তু ইসরাইল যুদ্ধ শেষ না করেই জিম্মিদের ফেরত চায়।"
ইসরায়েল বলছে, তারা তাদের সর্বশেষ প্রস্তাবের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রস্তাবটি গত সপ্তাহের শেষ দিকে পাঠানো হয়েছিল।
ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েল বন্দিদের মুক্তি শর্তে যে সংখ্যা ছিল তা কিছুটা কমানো হয়েছে যা, যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানো এবং মানবিক সহায়তা প্রবাহের বিনিময়ে হতে পারে।
টিকভা ফোরাম নামে পরিচিত জিম্মিদের একটি গ্রুপ সোমবার বলছে, ড. এতান মোরের মা-বাবাকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, সরকার এই চুক্তির ওপর কাজ করছে। এ চুক্তি অনুসারে ১০জনের মুক্তি পাওয়ার কথা। এর আগে সংখ্যা ১১ বা ১২ জন বলে ধারণা করা হয়েছিল।