হিন্দি বনাম তামিল: ভারতে ভাষা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে

দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে একটি শিক্ষানীতির কারণে বাগ্যুদ্ধ শুরু হয়েছে। শিক্ষানীতিতে ভারতের স্কুলে শিশুদের কোন ভাষায় পড়ানো হবে সে বিষয়ের উল্লেখ আছে। খবর বিবিসির।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার পাঁচ বছর আগে জাতীয় শিক্ষানীতি (এনইপি) ২০২০ প্রবর্তন করেন এবং ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন অভিযোগ করেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার তার রাজ্যকে শাস্তি দিচ্ছে, কারণ তারা এটি বাস্তবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে দিল্লি।
নরেন্দ্র মোদি প্রবর্তিত শিক্ষা নীতির একটি অংশে শিক্ষার্থীদের তিনটি ভাষা শেখানোর জন্য বলা হয়েছে। এখানে নির্দিষ্ট কোনো ভাষার উল্লেখ নেই। তবে সেখানে বলা হয়েছে, অন্তত দুটি ভাষা অবশ্যই ভারতের স্থানীয় হতে হবে।
স্ট্যালিন এ শিক্ষা নীতি বাস্তবায়ন না করার বেশ কিছু কারণ তুলে ধরেছেন। তবে সম্প্রতি তিনি অভিযোগ করেছেন, তিন ভাষা নীতির মাধ্যমে হিন্দি শেখা তামিলনাড়ুর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।
ভারতে রাজ্যগুলো মূলত ভাষাগতভাবে বিভক্ত। দেশটির প্রায় দুই ডজন সরকারি ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে হিন্দি, তামিল এবং ইংরেজিও অন্তর্ভুক্ত। তবে দক্ষিণের রাজ্যগুলো অভিযোগ করছে, কেন্দ্রীয় সরকার অন্যান্য ভাষার উপর হিন্দিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এটি তামিলনাড়ুর জন্য বিশেষভাবে সংবেদনশীল একটি বিষয়।
গত সোমবার ভারতের পার্লামেন্টে বিষয়টি নিয়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান সেদিন স্ট্যালিন ও তার দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে 'খারাপ ব্যবহার করার' অভিযোগ তোলেন।
ধর্মেন্দ্র প্রধান বলেন, "তাদের একমাত্র কাজ হলো ভাষার বাধা সৃষ্টি করা। তারা অগণতান্ত্রিক এবং অসভ্য।"
বিরোধ কী নিয়ে?
শিক্ষা সংবিধানের তালিকার একটি অংশ। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার উভয়ই এ বিষয়ে আইন তৈরি এবং প্রণয়ন করতে পারে। তাই স্কুল ও কলেজগুলোর সিলেবাস এবং নিয়ম অনুসরণ করে তা নির্ভর করে তারা কাদের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে, কেন্দ্রীয় না রাজ্য সরকার।
জাতীয় শিক্ষানীতি ভারতের শিক্ষাকে প্রচার এবং নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে তৈরি এবং সরকার এটি সময়ে সময়ে হালনাগাদ করে। সেই ধারা অনুসারে এনইপি ২০২০ চতুর্থ সংস্করণ।
তিনটি ভাষার ব্যবহার ১৯৬৮ সালের প্রথম সংস্করণ থেকেই এনইপিতে উল্লেখ আছে। এ বিধান প্রায়ই তামিলনাড়ুর মতো বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিবাদের মুখে পড়েছে।
এনইপি-এর অনেক সুপারিশ রাজ্য-চালিত স্কুলগুলোর জন্য আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক না। যার কারণে তামিলনাড়ু তার স্কুলগুলোতে কেবল দুটি ভাষা, ইংরেজি এবং তামিল ভাষা শেখায়। রাজ্যের নেতারা যুক্তি দিয়েছেন যে, তাদের মাতৃভাষা তামিল শেখার মাধ্যমে শিশুদের অন্যান্য বিষয়গুলো ভালোভাবে শিখতে সাহায্য করে এবং ইংরেজি আরও প্রতিশ্রুতিশীল সুযোগ তৈরি করে।
তামিলনাড়ুর সরকারি স্কুলগুলোও বছর ধরে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ এবং পরিকাঠামোর গুণগত মানসহ বিভিন্ন সূচকে করা জরিপগুলোতে ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছে।
সর্বশেষ এনইপি-তে বলা হয়েছে যে 'তিনটি ভাষার নীতি চালু থাকবে। তবে সেখানে আরও বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী সংস্করণগুলোর তুলনায় - এখানে 'বেশি নমনীয়তা' থাকবে এবং 'কোনো ভাষা কোনো রাজ্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না'।
কিন্তু স্ট্যালিন এবং তার দল অভিযোগ করেন, এই নীতির চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো হিন্দি ভাষাকে অ-হিন্দি ভাষী রাজ্যগুলোর উপর চাপিয়ে দেওয়া।
মুখ্যমন্ত্রী গত মাসে এক্স-এ লিখেছেন, হিন্দি ব্রিটিশ আমলে সহজে যোগাযোগের জন্য একটি একক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই হিন্দি ভাষা ব্যবহার করে এখন উত্তর ভারতে ব্যবহৃত অন্যান্য ভাষা এবং উপভাষাগুলো যেমন ভোজপুরি এবং আওধির উপর আধিপত্য বিস্তার করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
তার দলের এমপি কানিমোঝি কারুণানিধিও সম্প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন কেন একটি শিক্ষার্থীকে তিনটি ভাষা শেখার জন্য বাধ্য করা হবে।
ভারতীয় গণমাধ্যম এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "স্কুলে শিক্ষার্থীরা এমনিই যথেষ্ট চাপে থাকে। তাদের এতগুলো বিষয় শিখতে হয়। তার উপর দুটি ভাষার পরিবর্তে তিনটি ভাষা শেখার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে।"
তবে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান।
গত সপ্তাহে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, "আমরা কখনো এনইপি -তে বলিনি যে শুধু হিন্দি থাকবে; আমরা শুধু বলেছি যে শিক্ষা মাতৃভাষার ভিত্তিতে হবে। তামিলনাড়ুতে ভাষা তামিলই থাকবে।"
তাহলে এটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
বিরোধটি শেষে আরও তীব্র হওয়ার কারণ হলো, রাজ্যটি অভিযোগ করেছে, সমগ্র শিক্ষা অভিযানের অংশ হিসেবে তারা তাদের ভাগের তহবিল পায়নি। এ তহবিলটি কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে এনইপি বাস্তবায়নে অস্বীকার করায় তাদের এ তহবিল থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
গত আগস্টে ভারতীয় সংবাদপত্র 'হিন্দু'-তে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার তামিলনাড়ুকে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার জন্য একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করতে বলেছিল। তবে স্মারক অনুযায়ী কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মানে ছিল, রাজ্যটিকে এনইপি ২০২০ 'পুরোপুরি' গ্রহণ করতে হবে।
ডিসেম্বরে একজন কনিষ্ঠ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পার্লামেন্টে বলেন, তামিলনাড়ু কর্মসূচির জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেনি, যদিও প্রথমে এটি স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছিল।
ফেব্রুয়ারিতে, স্ট্যালিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি চিঠি লিখে অনুরোধ করেন যে জরুরি ভিত্তিতে প্রায় ২১.৫ বিলিয়ন রুপি (২৪৭ মিলিয়ন ডলার; ১৯১ মিলিয়ন পাউন্ড) পরিমাণ তহবিল ছাড় দেওয়া হোক।
ভারত কেন ভাষার ক্ষেত্রে এত সংবেদনশীল?
ভারত বিশ্বের অন্যতম ভাষাগতভাবে বৈচিত্র্যময় দেশ এবং কিছু অনুমান অনুসারে এখানে হাজার হাজার ভাষায় কথা বলা হয়।
কিন্তু এখানে মাত্র ২২টি সরকারি ভাষা রয়েছে, যার মধ্যে হিন্দিতে দেশটির ৪৬ শতাংশের বেশি লোক কথা বলে।
ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারত ছেড়ে যাওয়ার পর, স্বাধীন দেশটি ইংরেজি ভাষার পরিবর্তে হিন্দি ভাষাকে সংযোগ ভাষা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করেছিল। ১৯৫০ সালে প্রণীত সংবিধানও কেন্দ্রীয় সরকারকে হিন্দির প্রচার বাড়ানোর জন্য অনুপ্রাণিত করেছে।
এটি অ-হিন্দি ভাষী রাজ্যগুলোর তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫০ সালের পরবর্তী ১৫ বছর ধরে ইংরেজি ভাষাকে একটি বিকল্প সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে।
১৯৬৫ সালের নির্ধারিত বছর আসতে আসতে, হিন্দি 'চাপিয়ে দেওয়া' নিয়ে আতঙ্কের কারণে তামিলনাড়ু জুড়ে সহিংস প্রতিবাদ আবারও ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকার একটি আইন পাস করে যা ইংরেজি ভাষার সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহার অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তা দেয়।
তবে পরবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারগুলো এমন নীতি প্রবর্তন করেছে যা এই উদ্বেগগুলোকে চেপে রাখেনি।
১৯৬৮ সালের এনইপিতে প্রথমবারের মতো তিনটি ভাষার নীতি প্রবর্তন করা হয় এবং একই বছরে সরকার হিন্দি না বলা রাজ্যগুলোতে হিন্দি শেখানো বাধ্যতামূলক করার নীতি প্রবর্তন করে, যা নতুন প্রতিবাদের সৃষ্টি করে।
বছরের পর বছর, হিন্দি বনাম অন্যান্য ভাষার বিষয়টি বার বার সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে। ২০২৩ সালে মোদী সরকারের সমালোচনা করেন স্ট্যালিন।
একটি কেন্দ্রীয় সরকারের কমিশন স্বীকার করে, ১৯৪৮-৪৯ সালে ভাষা নীতির বিষয়টি আবেগপূর্ণ। এটিকে 'শান্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচনা করা কঠিন'।
সেখানে আরও বলা হয়, আর কোনো সমস্যা শিক্ষাবিদদের মধ্যে এত বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেনি এবং আমাদের সাক্ষীদের কাছ থেকেও এত বিপরীত মতামত আসেনি।