টিউশন ফি হিসেবে বিদেশে ৪০০ কোটি টাকা পাঠানো কি আদৌ সম্ভব?

সোমবার (১০ মার্চ) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছিলেন, এক ব্যক্তি তার ছেলের টিউশন ফি বাবদ ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাঠিয়েছেন। এ তথ্য অনেককে হতবাক করেছে। একইসঙ্গে, দেশ থেকে দেশের বাইরে লেনদেন ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ কতটা কার্যকর, সে বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করেছে।
শফিকুল আলম জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে পাওয়া প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে জানান, এ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।
প্রায় এক মাস আগে এনবিআর দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংককে চিঠি দিয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের জন্য খোলা ব্যাংক হিসাবগুলোর (স্টুডেন্ট ফাইল) বিস্তারিত তথ্য চেয়েছিল।
এনবিআরের একাধিক সূত্র টিবিএসকে জানিয়েছে, ওই ৪০০ কোটি টাকা কোনো একক ব্যক্তি নয়, বরং একাধিক ব্যক্তি বিদেশে পাঠিয়েছেন। তবে, পরিমাণটি এতটাই বড় যে, প্রশ্ন উঠছে—কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির বাইরে থেকে কীভাবে এত বিপুল অর্থ বিদেশে স্থানান্তর করা সম্ভব হলো?
টিবিএসের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ নির্বাহী এই পরিমাণ অর্থ স্থানান্তরের দাবি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি ৪০০ কোটি টাকার অঙ্কটিকে 'অস্বাভাবিক' বলে উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, তার ব্যাংকেই বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের সর্বাধিক হিসাব রয়েছে।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য বৈদেশিক লেনদেন প্রক্রিয়াকরণে ব্যাংকগুলোকে কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়।
'শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর একাধিক স্তরে যাচাইয়ের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এছাড়া, শিক্ষার্থীদের নামে ব্যাংক হিসাব খোলার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হয়, যা মাসিক পর্যালোচনা পরিচালনা করে। কোনো সন্দেহজনক লেনদেন ধরা পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ব্যাখ্যা দিতে বলে,' বলেন তিনি।
সাধারণত, শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয় না। তবে, ডিপ্লোমা কোর্স, স্কুল পর্যায়ের প্রশিক্ষণ বা অনলাইন প্রোগ্রামের মতো ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগে, তিনি জানান।
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক টিউশন ফি সাধারণত ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের মধ্যে থাকে। পাশাপাশি, জীবনযাত্রার ব্যয়ও প্রায় একই পরিমাণ হওয়ায় একজন শিক্ষার্থীর মোট বার্ষিক ব্যয় ৬০ হাজার ডলারের মতো দাঁড়ায়, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলো বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করার পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিপোর্ট পাঠায়, ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে আগেভাগে কোনো লেনদেন আটকে দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে, ব্যাংকগুলো সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে টিউশন ফি ও জীবনযাত্রার ব্যয় যাচাই করে, এরপরই অর্থ ছাড় দেয়।
'কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ব্যাংকিং ব্যবস্থার একাধিক স্তর বৈদেশিক লেনদেন পর্যবেক্ষণ করে। ফলে অতিরিক্ত অর্থ পাঠানোর সুযোগ নেই,' বলেন ওই নির্বাহী। 'তাছাড়া, শিক্ষার্থীদের অর্থ সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টেই জমা হয়, অর্থাৎ কোনো ধরনের অর্থ পাচার ঘটলে, তাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও যোগসাজশ থাকতে হবে।'
তিনি আরও জানান, শিক্ষার্থী অ্যাকাউন্ট থেকে ফেরত আসা অর্থের ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি রয়েছে। কোনো শিক্ষার্থী যদি ভিসা না পান বা ভর্তি বাতিল করেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থ ফেরত দিতে হয়।
এদিকে, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, যথাযথ নজরদারি না থাকলে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা সম্ভব।
তিনি বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংক-এ যেমন ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছিল, সেরকমই এভাবে অর্থ পাচারের জন্য ব্যাংকের ভেতরের শক্তিশালী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা থাকতে হয়।
ন্যাশনাল ব্যাংক কেলেঙ্কারির উদাহরণ দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেন, তৎকালীন চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের নির্দেশে ব্যাংকটি সিকদার পরিবারের ১১ সদস্যকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার কোটার বাইরে ৫৫ লাখ ডলার ব্যয়ের অনুমতি দিয়েছিল। তবে, ব্যাংকটি এ সংক্রান্ত তথ্য ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে জমা দেয়নি।
টিউশন ফি পরিশোধের নামে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যথাযথভাবে রিপোর্ট না করা হয়, তাহলে এ ধরনের লেনদেন সম্ভব। তবে, এটি কেবল ব্যাংকের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমেই ঘটতে পারে, বলেন বিএফআইইউ কর্মকর্তা।
ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যান। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলাদেশে শিক্ষার্থী হিসাব খোলেন। অর্থাৎ, বছরে কমপক্ষে ৬০ হাজার শিক্ষার্থী এ ধরনের হিসাব ব্যবহার করেন।
এনবিআরের ট্যাক্স ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের কমিশনার মো. আব্দুর রকিব টিবিএসকে বলেন, 'আমরা পাঁচটি ব্যাংক থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার ফাইল সংগ্রহ করেছি। আমাদের দল সেগুলো যাচাই-বাছাই করছে।'
'সব ফাইলই আমাদের তদন্তের আওতায় আসছে না। আমরা বড় অঙ্কের লেনদেন খতিয়ে দেখছি, যার সংখ্যা আনুমানিক ৫০০ হতে পারে,' বলেন তিনি।
এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ৪০০ কোটি টাকার লেনদেন নিয়ে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, 'আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। যখন পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যাবে, তখন জানানো হবে।'