৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণের বিচার: এটা কি সম্ভব? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

দেশব্যাপী একের পর এক ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার প্রতিবাদে চলমান বিক্ষোভের মধ্যে রোববার (৯ মার্চ) আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত এবং ৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ করতে হবে।'
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ করতে হয়।
আইন উপদেষ্টার প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো কীভাবে কাজ করবে তা বোঝার জন্য দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস) বিশেষজ্ঞদের কাছে তাদের মতামত জানতে চেয়েছে।
শুধু আইন পরিবর্তন করে ধর্ষণ কোনোভবেই কমানো সম্ভব নয়
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, 'শুধু আইনের পরিবর্তন করে ধর্ষণ কোনোভবেই কমানো সম্ভব নয়। কারণ এর আগে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড করা হলেও ধর্ষণের ঘটনা কমেনি, উল্টো বৃদ্ধি পেয়েছে।'
তিনি বলেন, 'সাধারণভাবে এই হিসাব কষলেই হবে যে ২০২০ সালে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আইন করা হলো। যদি আইন পরিবর্ত করেই ধর্ষণ বন্ধ করা যেত, তবে ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত গত ২৪ বছরে ধর্ষণ করে হত্যার যে অজস্র ঘটনা আমরা দেখেছি, তা ক্রমান্বয়ে কমে আসার কথা ছিল। সেটি হয়নি।'
এই আইনজ্ঞ বলেন, 'আইন উপদেষ্টা ধর্ষণের ঘটনায় মামলার তদন্ত ১৫ দিনে এবং বিচার ৯০ দিনে সম্পন্ন করার প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটি ডাইরেকটিভ, বাধ্যতামূলক নয়। কেউ এটি মানে না। না আদালত, না তদন্ত সংস্থা। এই সময়ের মধ্যে যদি তদন্ত সম্পন্ন না হয় বা বিচারকাজ শেষ না হয়, তাহলে কার ফল কী হবে? মামলা বাতিল হবে। তার মানে এই ধরনের সংশোধন অর্থহীন। শুধু আইন করে হবে না সেগুলো বাস্তবায়নের দিকে জোর দিতে হবে।'
তিনি বলেন, 'অপরাধ দমনে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। ঘটনা ঘটার পর সবার টনক নরে, সরকারের দিক থেকেও ব্যাপক প্রসংশিত উদ্যোগ নেয়। পরবর্তীতে এই বিষয়গুলো নিয়ে সরকারে পক্ষ থেকে আর কোনো সাড়া পাওয়া যায়না।'
আহসানুল করিম বলেন, 'সরকারের বিভিন্ন অর্গান রয়েছে নারী-শিশু নির্যাতন দমনের জন্য। সেগুলোর ফাংশন কী, কেউ সেগুলো জানে না। তাদের জাবাবদিহি আদৌ আছে কি-না সেটি স্পষ্ট নয়। আবার আইনের পরবির্তন করে মৃতুদণ্ড করা হচেছ, বিচারের সময় কমানো হচ্ছে, সেগুলো বিষয়ে সাধারণ মানুষ বা অপরাধীরা জানো। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।'
এই আইনজীবী বলেন, 'আইনের প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন এবং নির্যাতিতা নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা- এই বিষয়গুলোতে বড় সমস্যা রয়েছে। সে কারণে ধর্ষণের অভিযোগ বিচারের পর্যায়ে যেতেই অনেক সময় লেগে যায়। আবার নিম্ন আদালতে বিচার হওয়ার পর উচ্চ আদালতে মামলার জটে পরে যাচ্ছে।'
'তদন্তের সময় কমালে তদন্তকাজে বিঘ্ন ঘটতে পারে'
মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, 'আমার মনে হয় তদন্তের সময় কমালে তদন্তকাজে বিঘ্ন ঘটতে পারে। এত অল্প সময়ে মধ্যে তদন্ত করলে, সেটি সঠিকভাবে নাও হতে পারে। তদন্তে ও বিচারকাজের সময়সীমা কমিয়ে আসলে বিচারকে কতটুকু ফলপ্রসু করবে, সেটি নিয়ে সংশয় রয়ে যায়।'
তিনি বলেন, 'তদন্ত ও বিচারের সময়সীমা কমানোর চেয়ে জরুরি হলো ধর্ষণের ঘটনায় যে মামলাগুলো হচ্ছে, সেগুলো সঠিকভাবে ট্র্যাক করা, এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীদের ঠিকমতো সুরক্ষা দেওয়া, পুলিশ ও প্রসিকিউশনের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় করা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো ঠিকমতো আমলে নিলে, এই ঘটনাগুলো ঠিকমতো মোকাবিলা করতে পারব।'
তিনি আরও বলেন, 'নিঃসন্দেহ একটা ক্রাইসিস এখানে। এতোটা শর্টকাটে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।'
সারা হোসেন বলেন, 'এখানে যে সব কারণে এই সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়, যারা ধর্ষণ করছে তারা কেন পার পেয়ে যায়, সে বিষয়গুলো দেখা উচিত। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো, যিনি ভুক্তভোগী তার সুরক্ষা থাকে না। তার ওপর নানা ভয়-ভীতি হুমকি ধামকি দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে বিচার প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেজন্য ভিকটিমের সুরক্ষার বিষয় অন্যতম ব্যাপার।'
তিনি বলেন, 'আমরা বারবার দেখি যে তদন্ত সঠিকভাবে হয়না বলে অনেক মামলা আর অগ্রসর হয় না। তদন্ত প্রক্রিয়া, প্রসিকিউশন ও বিচার প্রক্রিযার সাথে যারা জরিত রয়েছেন, তাদের মধ্যে সাংঘাতিকভাবে সমন্বয়ের অভাব। এই জায়গাগুলোতে হাত দেওয়া জরুরি।'
'বিচার বিলম্বের কারণে নয়, ধর্ষণ প্রতিরোধে ব্যর্থতার পেছনে সরকারের অকার্যকর ভূমিকা'
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের মামলার তদন্ত ৩০ দিনের জায়গায় ১৫ দিনে এবং বিচারকাজ ১৮০ দিনের পরিবর্তে ৯০ দিনের মধ্যে করার যে প্রস্তাবের কথা বলেছেন, এটি নিশ্চয় সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।'
তিনি বলেন, 'তবে এই সময়ে বিচারকাজ বিলম্বের কারণে নারী নির্যাতনে ঘটনা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটি বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। আসলে সরকার এরকম ঘটনারোধে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুরোপুরি ব্যার্থ বলেই এরকম ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'মাগুরায় বা ঠাকুরগাঁওয়ে ধর্ষণের ঘটনায় এখন সবার টনক নড়েছে। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা আগেই ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়নি। এর আগে নারীর গায়ে থুথু দেওয়া, ওড়না ধরে টানাটানি করার ঘটনা ঘটেছে। আবার এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনতে না পারায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।'
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'শুধু আইনের পরিবর্তন করেই হবে না, সরকারকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাড়াতে হবে। পুলিশকে আরও শক্তিশালী ও নৈতিকতা সম্পন্ন করতে হবে। দ্রুত বিচারের পাশাপাশি প্রতিরোধে জোড়ালোভাবে কাজ করতে হবে।'