কোভিডের উৎস কি র্যাকুন ডগ? নতুন প্রমাণে সন্দেহ বাড়ছে বিজ্ঞানীদের

বিশ্বজুড়ে যখন পাঁচ বছর আগে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছিল, তখনও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি—এই ভাইরাসের উৎপত্তি কোথায়?
সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে চীনের উহানের হুয়ানান সামুদ্রিক খাবার বাজার থেকে বন্য প্রাণীদের মাধ্যমে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ সংক্রমণের অন্যতম প্রধান সম্ভাব্য বাহক হতে পারে র্যাকুন ডগ।
সাধারণত গবেষকদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, সান ডিয়েগোর স্ক্রিপস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিবর্তনবিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন জানান, র্যাকুন ডগের ওপর বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট এডওয়ার্ড হোমস প্রথম থেকেই এই প্রাণীটিকে সন্দেহ করছিলেন। ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারিতে সহকর্মীদের পাঠানো এক ই-মেইলে তিনি মজা করে বলেন, 'আমি বাজি ধরছি, এটি র্যাকুন ডগ।' কারণ, ২০১৪ সালে উহান সফরের সময় তিনি এই বাজারে র্যাকুন ডগ দেখেছিলেন।
তবে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনবিজ্ঞানী মাইকেল ওয়ারোবি মনে করেন, র্যাকুন ডগকে সন্দেহের তালিকার শীর্ষে রাখার অন্যতম কারণ হলো, এটি অন্য প্রাণীদের তুলনায় বেশি গবেষণার আওতায় এসেছে। ফলে আরও অন্যান্য প্রাণীও এই সংক্রমণের উৎস হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
নেদারল্যান্ডসের ইরাসমাস এমসির ভাইরোলজিস্ট ম্যারিয়ন কুপম্যানসও একমত। তিনি বলেন, 'আমাদের ধারণার সীমাবদ্ধতা রয়েছে, কোন প্রাণী থেকে প্রকৃতপক্ষে এই সংক্রমণ ছড়িয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন।'
বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এ বিষয়টির এখনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা মেলেনি। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীর মত, ভাইরাসটি চীনের দক্ষিণাঞ্চলের বাদুড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে। পরে তা কোনো মধ্যবর্তী প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করেছে। সরাসরি বাদুড় থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, যদিও উহান শহর বাদুড়ের আবাসস্থল থেকে অনেক দূরে।
তবে কিছু গবেষক এখনো দাবি করছেন, উহানের ভাইরোলজি ইনস্টিটিউট থেকে ভাইরাসটি ল্যাবরেটরি থেকে দুর্ঘটনাবশত কিংবা পরিকল্পিতভাবে বেরিয়ে যেতে পারে, যেখানে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা চলছিল।
ভাইরাসের বাহক
র্যাকুন ডগকে সম্ভাব্য প্রধান সংক্রমণ বাহক হিসেবে বিবেচনা করার অন্যতম কারণ হলো, এটি পূর্বেও মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের সাথে যুক্ত ছিল। ২০০৩ সালে, চীনের গুয়াংডং প্রদেশের একটি জীবন্ত প্রাণীর বাজার থেকে সার্স রোগের জন্য দায়ী ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ নমুনা সিভেট (খাটাশ) ও এক র্যাকুন ডগের শরীরে শনাক্ত করা হয়েছিল।
এ ঘটনা জার্মান গবেষকদের র্যাকুন ডগের ওপর আরও গবেষণা চালাতে উদ্বুদ্ধ করে। তারা দেখতে পান, এই প্রাণীগুলো সহজেই সার্স-কোভ-২ ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, নিজেরা তেমন অসুস্থ না হলেও, তারা সহজেই অন্য প্রাণীদের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে সক্ষম।
অস্ট্রেলিয়ার ভাইরোলজিস্ট এডওয়ার্ড হোমস ও তার সহকর্মীদের গবেষণায়ও উঠে এসেছে, চীনে বন্য ও খামারে পালিত র্যাকুন ডগ প্রায়ই বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম এমন ভাইরাস বহন করে। হোমস বলেন, 'র্যাকুন ডগ খুব সাধারণ ভাইরাস বাহক।'
সঠিক সময়, সঠিক স্থান
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের প্রথম দিকের অনেক সংক্রমণ হুয়ানান বাজার থেকে ছড়িয়েছিল, এটিকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কেন্দ্রস্থল বলা হয়।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ ও ২০২০ সালের জানুয়ারির শুরুতে সংক্রমিত ব্যক্তিদের শরীর থেকে পাওয়া সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের জিনগত নমুনা, তাদের অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য এবং মহামারি সংক্রান্ত বিশ্লেষণও এই তত্ত্বকে সমর্থন করে।
সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর চীনা কর্তৃপক্ষ হুয়ানান বাজার বন্ধ করে দেয়। তবে গবেষকরা নিশ্চিত, লোম এবং খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য সেখানে র্যাকুন ডগ বিক্রি হতো।
২০২১ সালের জুনে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৭ সালের মে থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত উহানের চারটি বাজারে প্রতি মাসে জীবিত বন্যপ্রাণীর কেনাবেচা নিয়ে জরিপ চালানো হয়। এতে উঠে আসে, শুধু হুয়ানান বাজারের সাতটি স্টলে প্রতি মাসে গড়ে ৩৮টি র্যাকুন ডগ বিক্রি হতো।
ওই সময় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া প্রাণী ছিল কাঁটাচুয়া বা আমুর হেজহগ (সজারু-সদৃশ কাঁটাধারী স্তন্যপায়ী জন্তু), মাসে গড়ে অন্তত ৩৩২টি। এছাড়া মাস্কড পাম সিভেট (গন্ধগোকুল), হগ ব্যাজার (স্থানীয় ভাষায় গোর খোদক বা বালি খোদক শূকর), বাঁশ ইঁদুর এবং মালয়ান পোর্কুপাইনও (এক ধরনের শজারু) নিয়মিত বিক্রি হতো।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে হুয়ানান বাজারের বিক্রির রেকর্ডে বাঁশ ইঁদুর, শজারু এবং কাঁটাচুয়াসহ অন্যান্য জীবিত প্রাণী বা তাদের পণ্য কেনাবেচার তথ্য রয়েছে।
২০২৩ সালে র্যাকুন ডগ সংক্রান্ত তত্ত্বকে আরও জোরালো করার প্রমাণ পাওয়া যায়। চীনের গবেষকরা ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাজারটি বন্ধ হওয়ার পর সেখানে বিভিন্ন জায়গা—যেমন দোকান, ময়লার বিন ও নর্দমা থেকে সংগৃহীত নমুনার জিনগত তথ্য প্রকাশ করেন।
গবেষণায় দেখা যায়, কিছু নমুনায় সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের পাশাপাশি র্যাকুন ডগের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ পাওয়া গেছে। এছাড়া, হোয়ারি ব্যাম্বু রেটও (বাঁশ ইঁদুর) অন্যতম বেশি শনাক্ত হওয়া স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণী ছিল। সিভেট ও হগ ব্যাজারের নমুনাও পাওয়া গেছে, তবে সংখ্যায় কম।
গবেষক অ্যান্ডারসনের মতে, এটি প্রমাণ করে না যে প্রাণীগুলো সার্স-কোভ-২ ভাইরাসে সংক্রমিত ছিল, তবে যদি সংক্রমিত হয়ে থাকে, তাহলে এমন প্রমাণই পাওয়া স্বাভাবিক।
কানাডার সাসকাটুনে ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচেওয়ানের ভাইরোলজিস্ট অ্যাঞ্জেলা রাসমুসেনের এক অপ্রকাশিত গবেষণায় উঠে আসে যে, বাজারে থাকা কিছু র্যাকুন ডগ ও গ্রেটার হগ ব্যাজার সম্ভবত অসুস্থ ছিল। তবে তারা কোন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল, সেটি নিশ্চিত নয়।
বাজারে থাকা অন্যান্য প্রাণী, যেমন বাঁশ ইঁদুর, মালয়ান শজারু ও আমুর হেজহগ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারে এবং সেটি হয়ত মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে। তবে এই প্রাণীগুলো সার্স-কোভ-২ সংক্রমণের জন্য কতটা সংবেদনশীল বা এটি কীভাবে ছড়ায়, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
কোষীয় গবেষণায় দেখা গেছে, হিমালয়ান পাম সিভেট (মুখোশধারী গন্ধগোকুল) ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে, তবে তারা অন্য প্রাণীতে সংক্রমণ ঘটাতে পারে কিনা, তা জানা যায়নি। কারণ, এ ধরনের গবেষণা ব্যয়বহুল এবং মহামারির শুরুতে তা গবেষণার অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল না বলে জানান বিজ্ঞানী কুপম্যানস।
তিনি আরও বলেন, বাজারে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী থাকতে পারে, যাদের উপস্থিতি শনাক্ত হয়নি। অনেক বন্যপ্রাণী বিক্রির অনুমতি নেই, ফলে তাদের কেনাবেচার রেকর্ড নাও থাকতে পারে। এছাড়া, গবেষকরা যখন নমুনা সংগ্রহ করেন, তখন সংক্রমণের মূল ঘটনা ঘটে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গিয়েছিল।
কোথা থেকে এসেছে?
বেশিরভাগ গবেষক মনে করেন, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের উৎপত্তি সম্ভবত দক্ষিণ চীনের ইউনান, লাওস বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের রাইনোলোফাস প্রজাতির বাদুরের মধ্যে হয়েছে। কারণ, এই অঞ্চলেই ভাইরাসটির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে।
তবে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি কীভাবে এই ভাইরাস ১ হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে উহানে পৌঁছাল, যা বাদুর-সংক্রমিত ভাইরাসগুলোর সাধারণ বিস্তারের এলাকা থেকে অনেক দূরে।
এই কারণে সন্দেহভাজন মধ্যস্থ প্রাণীগুলোর ভৌগোলিক বিস্তৃতি বিবেচনা করা জরুরি, যাতে বোঝা যায়, তারা কি বাদুড়দের সঙ্গে একই এলাকায় বাস করত কিনা—বলেন আলেক্স ক্রিটস-ক্রিস্টোফ, যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটেশনাল জীববিজ্ঞানী।
উহানের হুয়ানান বাজারে বিক্রি হওয়া প্রাণীদের মধ্যে বন্য র্যাকুন ডগ, সিভেট, হোয়ারি ব্যাম্বু রেট ও গ্রেটার হগ ব্যাজারের বিস্তৃতি রাইনোলোফাস বাদুরের বসবাসের সঙ্গে মিলে যায়।
এই তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে, হুয়ানান বাজারে পাওয়া র্যাকুন ডগ মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খামারে পালিত র্যাকুন ডগের সঙ্গে মেলে না। বরং এটি চীনের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের বন্য র্যাকুন ডগের সঙ্গে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া গেছে।
তবে এই তথ্য নতুন একটি প্রশ্নও তৈরি করে, বলেন কুপম্যানস। একটি প্রাণী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাইরাস দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকতে হলে প্রাণীগুলোর সংখ্যা যথেষ্ট বেশি হতে হবে। অন্যথায়, ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে গিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
কিন্তু দক্ষিণ চীনে র্যাকুন ডগ খামার পর্যায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যায় পালন করা হয় কি না, সেটি স্পষ্ট নয়, বলেন কুপম্যানস। অবশ্য, কোনো একটি দুর্ভাগ্যজনক ব্যাচ যদি বাদুড় থেকে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে তারা যেকোনো মধ্যস্থ প্রাণীই হতে পারত, এমনকি মালয়ান প্যাঙ্গোলিনও (বনরুই), যাদের মধ্যে সার্স-কোভ-২-এর ঘনিষ্ঠ প্রজাতির করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে।
তবে, মহামারির শুরুর দিকের নতুন তথ্য ছাড়া ঠিক কী ঘটেছিল তা নির্ধারণ করা কঠিন, বলেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গের বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী জনাথন পেকার।
যে-সব গবেষণা এই রহস্য উন্মোচনে সাহায্য করতে পারত—যেমন হুয়ানান বাজারে বিক্রি হওয়া প্রাণীগুলো কোথা থেকে এসেছিল তা চিহ্নিত করা, বা বন্যপ্রাণী ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের পরীক্ষা করা—তা করা হয়নি।
এর প্রধান কারণ হিসেবে গবেষকরা মনে করেন, মহামারির প্রথম দিকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণই ছিল মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি, স্থানীয় ও বৈশ্বিক রাজনীতি এই গবেষণার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।