দুর্ভিক্ষের কবলে গাজা—বিশ্ব কীভাবে বুঝবে যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে?

জাতিসংঘ সতর্ক করে জানিয়েছে, শিগগিরই কোনো পদক্ষেপ না নিলে গাজায় ব্যাপক দুর্ভিক্ষ 'প্রায় অনিবার্য'।
জাতিসংঘের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সতর্ক করে জানিয়েছেন, গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে এক চতুর্থাংশ মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে আর এক পা দূরে আছে।
দুর্ভিক্ষ কী এবং কে ঘোষণা করে?
ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশনের (আইপিসি) মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ মূল্যায়ন করা হয়।
জাতিসংঘের এক ডজনেরও বেশি সংস্থা, বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থা ও ত্রাণ সংস্থার সমন্বয়ে এই উদ্যোগ গঠন করা হয়েছে।
কোনো দেশের মোট জনসংখ্যার কমপক্ষে ২০ শতাংশ চরম খাদ্য ঘাটতিতে ভুগলে, প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন তীব্র অপুষ্টিতে ভুগলে এবং প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে দুজন প্রতিদিন অনাহারে বা অপুষ্টি ও রোগে মারা গেলে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়।
গত ১৩ বছরে দুইবার দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছে: ২০১১ সালে সোমালিয়ায় এবং ২০১৭ সালে দক্ষিণ সুদানের কিছু অংশে।
গাজার বর্তমান অবস্থা কী?
ডিসেম্বরের শেষের দিকে আইপিসি জানায়, গাজার পরিস্থিতি এরই মধ্যে ২০ শতাংশের সীমা অতিক্রম করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাকি দুটি শর্ত- তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা এবং অনাহারে বা অপুষ্টি ও রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যাও আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই 'সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে'।
এতে বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে বা আরও খারাপ হলে, ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ শুরুর ঝুঁকি রয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ জানিয়েছিল, গাজার ২৩ লাখ মানুষের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি অসহনীয় মাত্রার বঞ্চনা ও খাদ্য সঙ্কটে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এতে বলা হয়, এই মুহূর্তে কোনো পদক্ষেপ না নিলে, গাজাজুড়ে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ 'প্রায় অনিবার্য' হয়ে উঠতে পারে।
আইপিসি মার্চের মাঝামাঝি সময়ে গাজার পরিস্থিতি নিয়ে একটি নতুন বিশ্লেষণ প্রকাশ করার কথা রয়েছে।
দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করার ফলাফল কী?
যদিও দুর্ভিক্ষের ঘোষণা কোনো আনুষ্ঠানিক ফলাফল আনতে পারে না, তবে এটি বিশ্বব্যাপী মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সহায়তা করতে পারে।
তবে জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় যেমন বলেছে, 'একবার দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হলে, তা অনেকের জন্যেই অনেক দেরি হয়ে যাবে।'
গাজার মানুষের খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব কার?
জাতিসংঘ ইসরায়েলকে গাজায় দখলদার শক্তি হিসেবে মনে করে।
সংস্থাটি জানায়, গাজায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সহজতর করা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব।
১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের অধীনে যুদ্ধের আইন অনুযায়ী, সম্ভাব্য সব রকম উপায়ে দখলদার শক্তির যুদ্ধে আহতদের এবং যুদ্ধাঞ্চল ও এর কাছাকাছি এলাকায় বেসামরিক নাগরিকদের খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ করার সুস্পষ্ট দায়বদ্ধতা রয়েছে।'
ইসরায়েল কি বলছে?
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয় ইসরায়েল। এগুলো ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের এলাকা, ফিলিস্তিনিরা একটি রাষ্ট্র হিসেবে এই অঞ্চল ফেরত পেতে চায়।
২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় এবং ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাস জয়লাভ করে। কিন্তু প্রতিবেশী মিশরসহ ইসরাইল এখনও উপত্যকার সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করছে।
ইসরায়েলি নেতারা দীর্ঘদিন ধরে যুক্তি দিয়েছেন, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় জর্ডান ও মিশর থেকে গাজা ও পশ্চিম তীর দখল করা হয়েছিল, তারা সার্বভৌম ফিলিস্তিন দখল করেনি। ইসরায়েল এই ভূমির সঙ্গে ইহুদি জনগণের ঐতিহাসিক ও বাইবেলীয় সম্পর্কের উপর জোর দেয়।
গাজার মানবিক পরিস্থিতি এত ভয়াবহ কেন?
ইসরায়েলি হিসাব অনুযায়ী, গত ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে প্রায় ১২০০ জনকে হত্যা ও ২৫৩ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়। জবাবে গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলি হামলায় ৩০ হাজার ৬০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
বর্তমানে মিশর থেকে রাফাহ ক্রসিং এবং ইসরায়েল থেকে কেরেম শালোম ক্রসিং হয়ে দক্ষিণ গাজায় ত্রাণ সরবরাহ করা হয়।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯৭টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করতে পেরেছে, জানুয়ারিতে প্রতিদিন প্রায় ১৫০টি ট্রাক ছিল, যা দিনে ৫০০ ট্রাকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম।
জাতিসংঘ ত্রাণ প্রবেশাধিকারকে 'অপর্যাপ্ত' বলে জানিয়ে এর কারণ হিসেবে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, নিরাপত্তাহীনতা এবং প্রয়োজনীয় সরবরাহের ওপর ব্যাপক বিধিনিষেধকে দায়ী করেছে।
বিশেষ করে সীমান্ত পারাপার বন্ধ, চলাচলে গুরুতর বিধিনিষেধ, প্রবেশাধিকার প্রত্যাখ্যান, কঠোর যাচাই-বাছাই পদ্ধতি, নিরাপত্তা ঝুঁকি, বেপরোয়া বেসামরিক নাগরিকদের ঘটনা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়া এবং যোগাযোগ ও সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের উপর বিধিনিষেধ প্রভৃতি কারণের কথা উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।
ইসরায়েল বলেছে, তারা গাজার মানবিক পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বেসামরিক নাগরিকদের জন্য সহায়তার কোনো বাধা নেই।
তারা মানবিক সহায়তা সরবরাহের সমস্যার জন্য জাতিসংঘকে দোষারোপ করে বলেছে, সহায়তার পরিমাণ ও গতির সীমাবদ্ধতা জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার সক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল।
সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি