বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টকেও মামলার হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প
আদালতের কাঠগড়া যেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে প্রিয় রণক্ষেত্র। প্রতিপক্ষ? গণমাধ্যম, সাংবাদিক, লেখক—এককথায় তার যেকোনও সমালোচক। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতার চেয়ারে বসার আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই গণমাধ্যমের ওপর খাপ্পা ডোনাল্ড ট্রাম্প। গণমাধ্যমকে বরাবরই তিনি বলে এসেছেন 'গণমানুষের শত্রু'।
দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ট্রাম্প, যদিও এর মধ্যে কয়েকটি ইতিমধ্যেই আদালতে খারিজ হয়ে গেছে।
এর আগে বিবিসির চেয়ারম্যান সমির শাহ ট্রাম্পের পক্ষে থেকে মামলা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, 'ট্রাম্প একজন 'মামলাপ্রিয় মানুষ'। তাই আমাদের সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।'
ক্ষমতায় আসার পর কখনো ৪৭৫ মিলিয়ন ডলার, কখনো ১০০ মিলিয়ন ডলার, আবার কখনো শত কোটি ডলারের মামলার খড়্গ ঝুলছে বিশ্বের নামীদামী সব সংবাদমাধ্যমের ওপর। তালিকায় আছে সিএনএন, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে শুরু করে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস করা কিংবদন্তি সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড এবং ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি পর্যন্ত।
অনেকেরই মতে, এসব মামলার মূল উদ্দেশ্য শুধু জয়লাভ নয়, বরং সমালোচক গণমাধ্যমগুলোকে আইনি মারপ্যাঁচে ফেলে হয়রানি করা এবং তাদের কণ্ঠরোধ করা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকলেও মামলার দীর্ঘসূত্রিতা ও বিপুল আইনি খরচ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বড় এক চাপ।
ট্রাম্পের আইনি লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় লক্ষ্যগুলোর একটি সিএনএন। ২০২২ সালের অক্টোবরে এই টেলিভিশন নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে ৪৭৫ মিলিয়ন ডলারের মানহানির মামলা করেন তিনি। ট্রাম্পের অভিযোগের তীর ছিল সিএনএনের প্রতিবেদনের দিকে, যেখানে তাকে 'বর্ণবাদী', 'রাশিয়ার দালাল' এবং 'হিটলারের' মতো তকমা দেওয়া হয়েছিল।
মামলার আর্জিতে বলা হয়, ২০২০ সালের নির্বাচনি জালিয়াতির অভিযোগকে সিএনএন বারবার 'বিগ লাই' বলে প্রচার করেছে। এই 'বিগ লাই' শব্দবন্ধটি নাৎসি প্রচারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট—এমনটা মনে করিয়ে দিয়ে ট্রাম্পের আইনজীবীরা বলেন, সিএনএন জেনেশুনে তার সম্মানহানি করেছে। মামলাটি এখনো বিচারাধীন।
সম্প্রতি দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা এবং এর চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ১৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের মানহানির মামলা দায়ের করেন ট্রাম্প।
মামলার প্রেক্ষাপট হিসেবে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রকাশিত পত্রিকাটির বেশ কয়েকটি নিবন্ধ এবং একটি বইয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এসব লেখায় ইচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষপূর্ণভাবে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
এর আগে একবার ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ এনে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস। পরে সেই ধারাবাহিক প্রতিবেদন পুলিৎজার পুরষ্কার লাভ করে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছিল, সন্দেহজনক কর স্কিমের মাধ্যমে লাখ লাখ ডলারের মালিক হয়েছেন ট্রাম্প। যদিও ট্রাম্পের দাবি ছিল, তিনি বৈধভাবেই ধনকুবের হয়েছেন। ২০১৮ সালে এ সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্ত শুরু করে নিউইয়র্ক টাইমস।
সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২০২১ সালে ট্রাম্প নিউইয়র্ক টাইমসের বিরুদ্ধে 'কপট চক্রান্তের' অভিযোগ এনে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মানহানি মামলা করেন।
ট্রাম্পের দাবি, সাংবাদিকেরা ষড়যন্ত্র করে মেরিকে দিয়ে তার পুরনো কর সংক্রান্ত গোপন নথি হাতিয়ে নিয়েছেন। তবে এই মামলায় ট্রাম্পকে উল্টো ধাক্কা খেতে হয়েছে। ২০২৩ সালের মে মাসে আদালত দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের বিরুদ্ধে মামলাটি খারিজ করে দেন।
বিচারক তার রায়ে বলেন, সংবাদ সংগ্রহের এই স্বাধীনতা মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনী দ্বারা সুরক্ষিত। শুধু মামলাই খারিজ হয়নি, উল্টো ট্রাম্পকেই আদালতের নির্দেশ দেওয়া হয় পত্রিকাটির আইনি খরচ বাবদ প্রায় ৪ লাখ ডলার পরিশোধ করার জন্য।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস করে খ্যাতি পাওয়া প্রবীণ সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডও ট্রাম্পের মামলার শিকার হতে হয়েছিল। ২০২৩ সালে উডওয়ার্ড, তার বইয়ের প্রকাশক সিমন অ্যান্ড শুস্টার এবং এর মূল কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের মামলা করেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের দাবি, তার বই 'রেইজ' -এর জন্য নেওয়া সাক্ষাৎকারের অডিও টেপগুলো 'দ্য ট্রাম্প টেপস' নামে অডিওবুক আকারে প্রকাশের কোনো অনুমতি তিনি দেননি। এটি তার কপিরাইট লঙ্ঘন করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। জবাবে উডওয়ার্ড ও তার প্রকাশক মামলাটিকে 'ভিত্তিহীন' বলেছেন। তাদের মতে, সাক্ষাৎকারগুলো অন-দ্য-রেকর্ড ছিল এবং জনস্বার্থেই তা প্রকাশ করা হয়েছে।
ট্রাম্পের এই আইনি অভিযানের তালিকা বেশ দীর্ঘ। এবিসি নিউজ এবং এর উপস্থাপক জর্জ স্টেফানোপোলাসের বিরুদ্ধে করা একটি মামলা অবশ্য আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি হয়েছে। একজন লেখককে যৌন নির্যাতনের জন্য আদালত ট্রাম্পকে দায়ী করলেও উপস্থাপক ভুলবশত 'ধর্ষণ' শব্দটি ব্যবহার করায় এই মামলা করা হয়। সমঝোতা হিসেবে এবিসি নিউজ ট্রাম্পের প্রেসিডেনশিয়াল লাইব্রেরির জন্য ১৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিতে সম্মত হয়।
২০০৫ সালে সাংবাদিক ও লেখক টিমোথি ও'ব্রায়েন তার 'ট্রাম্পনেসশন: দ্য আর্ট অফ বিং ডোনাল্ড' বইটিতে ট্রাম্পের প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বিভিন্ন সূত্রের বরাতে দাবি করেন, ট্রাম্পের সম্পদের পরিমাণ ১৫০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার, যেখানে ট্রাম্প নিজেকে বহু বিলিয়নের মালিক বলে দাবি করতেন।
এই 'অপমানের' জবাবে ট্রাম্প লেখকের বিরুদ্ধে ৫ বিলিয়ন ডলারের মানহানির মামলা করেন। কিন্তু প্রায় পাঁচ বছর ধরে মামলা চলার পর ২০০৯ সালে আদালত তা খারিজ করে দেন। বিচারক জানান, ট্রাম্প প্রমাণ করতে পারেননি যে লেখক জেনেশুনে মিথ্যা তথ্য ছেপেছেন। বরং মামলা চলাকালীন ট্রাম্প নিজেই স্বীকার করেন যে, তিনি তার সম্পদের পরিমাণ বিভিন্ন সময়ে পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে বাড়িয়ে-কমিয়ে বলেন।
২০১৮ সালে প্রকাশিত মাইকেল উলফের 'ফায়ার এন্ড ফিউরি: ইন্সাইড দ্য ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ' বইটি ট্রাম্প প্রশাসনে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। বইটির প্রকাশনা বন্ধ করতে ট্রাম্পের আইনজীবীরা লেখক ও প্রকাশককে 'অবিলম্বে প্রকাশনা বন্ধ ও বিরত থাকার' আইনি নোটিশ পাঠান।
বইটিকে 'মিথ্যায় পরিপূর্ণ' আখ্যা দিয়ে মানহানির মামলার হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু এই হুমকি উল্টো ফল দেয়। প্রকাশক আইনি হুমকির মুখে বইটির প্রকাশনা আরও এগিয়ে আনেন, যার ফলে বিক্রি বহুগুণে বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প আর আনুষ্ঠানিক মামলা করেননি।
সবচেয়ে সাম্প্রতিক হুমকিটি এসেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির বিরুদ্ধে। ট্রাম্প চলতি মাসে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত কোটি ডলারের মামলার হুমকি দেন।
তার অভিযোগ, একটি তথ্যচিত্রে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনায় উসকানি দেওয়ার জন্য তার ভাষণ বিকৃতভাবে সম্পাদনা করে প্রচার করা হয়েছে। এই বিতর্কের জেরে ইতোমধ্যে বিবিসির মহাপরিচালক এবং সংবাদ বিভাগের প্রধান পদত্যাগ করেছেন।
