গাজা যুদ্ধের সময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরব রাষ্ট্রগুলোর গোপন সহযোগিতা বেড়েছে

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানালেও, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি প্রভাবশালী আরব রাষ্ট্র গোপনে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করেছে—এমন তথ্য উঠে এসেছে ফাঁস হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নথিতে। সেপ্টেম্বর মাসে কাতারে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর সম্পর্ক কিছু সময়ের জন্য সংকটে পড়লেও, এই সহযোগিতাই এখন গাজায় নবগঠিত যুদ্ধবিরতির তদারকিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও ছয়টি আরব দেশের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা বাহরাইন, মিসর, জর্ডান এবং কাতারে একাধিক পরিকল্পনা বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।
বুধবার ইসরায়েল ও হামাস একটি প্রাথমিক শান্তি কাঠামোয় সম্মত হয়েছে, যার আওতায় হামাসের হাতে আটক সব জিম্মি মুক্তি পাবে এবং গাজা থেকে আংশিকভাবে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছে যে, যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে সহায়তা দিতে ২০০ মার্কিন সেনা ইসরায়েলে পাঠানো হবে, যাদের সঙ্গে ওই সহযোগিতা কাঠামোর অংশ থাকা কয়েকটি আরব দেশের সেনারাও যোগ দেবেন।
এই ঘোষণার আগেই সংশ্লিষ্ট আরব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা গাজা শান্তি পরিকল্পনায় সমর্থন জানিয়েছিল। ওই পরিকল্পনায় গাজায় একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েনের কথা বলা হয়েছে, যা সেখানে নতুন একটি ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনী প্রশিক্ষণ দেবে।
এক যৌথ বিবৃতিতে ছয়টি আরব দেশের মধ্যে পাঁচটি জানিয়েছে, তারা এমন একটি নিরাপত্তা কাঠামো গঠনের পক্ষে যা "সব পক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।" তবে তারা প্রকাশ্যে সৈন্য পাঠানোর বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, কাতার—যার রাজধানী ৯ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল—গোপনে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছিল। ২০২৪ সালের মে মাসে ইসরায়েলি ও আরব সামরিক কর্মকর্তারা কাতারের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে বৈঠক করেন—যা যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি। বৈঠকের পরিকল্পনাপত্রে দেখা যায়, ইসরায়েলি প্রতিনিধিরা সরাসরি ওই ঘাঁটিতে অবতরণ করার কথা ছিল, যাতে কাতারের বেসামরিক বিমানবন্দরে তাদের উপস্থিতি প্রকাশ না পায়।
ট্রাম্প প্রশাসনের চাপের মুখে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ২৯ সেপ্টেম্বর কাতারের কাছে ওই হামলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে এমন হামলা না চালানোর প্রতিশ্রুতি দেন।
নথি অনুযায়ী, ইরানের হুমকিই ছিল এই গোপন সামরিক সহযোগিতার মূল চালিকা শক্তি, যা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম) তত্ত্বাবধান করছিল। এক নথিতে ইরান ও তার মিত্র মিলিশিয়াদের "অ্যাক্সিস অব ইভিল" বলে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্য একটি মানচিত্রে গাজা ও ইয়েমেনের ওপর ক্ষেপণাস্ত্রের চিহ্ন দিয়ে ইরানের প্রভাব বোঝানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান সাংবাদিকদের সংগঠন (আইসিআইজে) ও ওয়াশিংটন পোস্ট কর্তৃক যাচাইকৃত পাঁচটি সেন্টকম পাওয়ারপয়েন্ট উপস্থাপনা "রিজিওনাল সিকিউরিটি কনস্ট্রাক্ট" নামে একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোর বিস্তারিত প্রকাশ করেছে। এতে ইসরায়েল, কাতার, বাহরাইন, মিসর, জর্ডান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত অন্তর্ভুক্ত ছিল। কুয়েত ও ওমানকে "সম্ভাব্য অংশীদার" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যারা সব বৈঠকের বিষয়ে অবহিত ছিল।
নথিগুলো ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রস্তুত হয়—গাজা যুদ্ধ শুরুর আগে এবং পরেও। এর তথ্য মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের রেকর্ড, সামরিক নথি ও অন্যান্য উন্মুক্ত সূত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে।
সেন্টকম, ইসরায়েল ও সংশ্লিষ্ট ছয়টি আরব দেশ এই বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
একটি নথি অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকির ফোর্ট ক্যাম্পবেল ঘাঁটিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশীদার দেশগুলোকে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ শনাক্ত ও ধ্বংসের কৌশল শেখানো হয়—যা হামাসের অন্যতম কৌশল হিসেবে গাজায় ব্যবহৃত হয়েছে।
আরেক নথিতে বলা হয়, অংশীদার দেশগুলোর মধ্যে ছয়টি দেশ এই প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। সেন্টকম কর্মকর্তারা ইরানের প্রচারণা মোকাবিলা ও "আঞ্চলিক উন্নয়ন ও সহযোগিতার ইতিবাচক বর্ণনা প্রচার" করতে তথ্যমূলক অভিযান পরিকল্পনাও চালান।
কিন্তু, গোপনে ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সহযোগিতা চললেও, প্রকাশ্যে আরব নেতারা গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের নিন্দা জানিয়ে আসছেন। মিসর, জর্ডান, কাতার ও সৌদি আরবের নেতারা এই অভিযানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে কাতারের আমির ইসরায়েলকে "অ্যাপারথাইড রাষ্ট্র" বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, "এটি ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে চালানো গণহত্যার যুদ্ধ।"
সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও আগস্টে ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করে বলেছিল, তারা "ক্ষুধায় কাতর" ফিলিস্তিনিদের ওপর "জাতিগত নিধনযজ্ঞ" চালাচ্ছে।
তবে নথিগুলোতে বলা হয়েছে, এই সামরিক অংশীদারিত্ব "কোনো নতুন জোট নয়" এবং এর "সব বৈঠক গোপনভাবে অনুষ্ঠিত হবে।"
আন্তর্জাতিক কৌশল বিষয়ক থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিচালক ইমিল হোকায়েম বলেন, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বাস করে আসছে যে সামরিক সহযোগিতা ইসরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক স্বাভাবিকীকরণে সহায়তা করবে। তবে তার মতে, "এই গোপন সহযোগিতা বাস্তব উত্তেজনাগুলো আড়াল করে রাখছে।"
তিনি বলেন, তবে "কাতারে ইসরায়েলি হামলার পর এই দ্বন্দ্ব প্রকটভাবে সামনে এসেছে—একজন মার্কিন মিত্র অপর মিত্রের ওপর হামলা চালিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র যেন এতে নির্বিকার থেকেছে। এই অবিশ্বাস বহু বছর ধরে মার্কিন প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।"
নীরব কিন্তু গভীর অংশীদারিত্ব
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তারা এই অংশীদারিত্বের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও, ইসরায়েলি-আরব সহযোগিতার মাত্রা নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। ২০২২ সালে তৎকালীন সেন্টকম প্রধান জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি কংগ্রেসে বলেন, এই সহযোগিতা "আব্রাহাম চুক্তির গতি বজায় রেখে এগোচ্ছে"—যার মাধ্যমে ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
নথি অনুযায়ী, গত তিন বছরে এই নিরাপত্তা কাঠামোর কেন্দ্রীয় অংশ হিসেবে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন মোকাবিলায় যৌথ আকাশ প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বাস্তব রূপ পেয়েছে। ২০২২ সালে নিরাপত্তা সম্মেলনে ইসরায়েল ও আলোচিত আরব দেশগুলো এই পরিকল্পনায় স্বাক্ষর করে সামরিক মহড়া ও যৌথ সরঞ্জাম ক্রয়ের বিষয়ে সম্মত হয়।
২০২৪ সালের মধ্যে সেন্টকম অংশীদার দেশগুলোর অনেককেই নিজেদের রাডার ও সেন্সর নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম হয়, ফলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ডেটা দেখতে ও নিজেদের তথ্য শেয়ার করতে পারে।
তবে এই ব্যবস্থা কাতারকে ৯ সেপ্টেম্বরের ইসরায়েলি হামলা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের রাডার বা স্যাটেলাইট ব্যবস্থা হামলার আগাম বার্তা দিতে ব্যর্থ হয়। কাতারও জানায়, তাদের নিজস্ব রাডারও ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করতে পারেনি।
যদিও কাতার ও সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, তবে ফাঁস হওয়া নথিগুলোতে দেখা যায়, এই দুই উপসাগরীয় রাষ্ট্রই পর্দার আড়ালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
২০২৪ সালের মে মাসে আল-উদেইদ ঘাঁটির নিরাপত্তা সম্মেলনে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা উপস্থিত প্রতিটি আরব দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। নথিতে স্পষ্টভাবে নির্দেশ ছিল: "অংশগ্রহণকারীরা কোনো ছবি তুলবেন না বা গণমাধ্যমকে প্রবেশাধিকার দেবেন না।" খাদ্য তালিকায়ও বিশেষভাবে উল্লেখ ছিল—"শুকরের মাংস বা ক্রাস্টেশিয়ান পরিবেশন করা যাবে না।"
সৌদি আরবও এই সহযোগিতায় সক্রিয় ভূমিকা নেয়, ইসরায়েল ও অন্যান্য আরব অংশীদারদের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করে। ২০২৫ সালের এক বৈঠকে সৌদি ও মার্কিন কর্মকর্তারা সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, রাশিয়া ও তুরস্কের ভূমিকা, ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুথি গোষ্ঠীর হুমকি এবং সিরিয়া-ইরাকে ইসলামিক স্টেটের কার্যক্রম নিয়ে যৌথ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সেন্টকম আগামী বছরগুলোতে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।
২০২৪ সালের এক ব্রিফিং নথিতে ২০২৬ সালের মধ্যে "কম্বাইন্ড মিডল ইস্ট সাইবার সেন্টার" গঠনের প্রস্তাব করা হয়, যা প্রতিরক্ষামূলক সাইবার প্রশিক্ষণ ও মহড়ার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। আরেক নথিতে "ইনফরমেশন ফিউশন সেন্টার" গঠনের প্রস্তাব রয়েছে, যেখানে অংশীদাররা দ্রুত তথ্য বিশ্লেষণ ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
এক সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, "উপসাগরীয় দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে বাস্তববাদী সম্পর্ক রাখে—এবং তাদের সামরিক দক্ষতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে। তারা বিশ্বাস করে, ইসরায়েল যখন যা চায়, তখনই তা করতে পারে—আর কেউ টেরও পায় না।"
যদিও হামাস ও ইসরায়েল কেবল প্রাথমিক পর্যায়ের শান্তিচুক্তিতে পৌঁছেছে, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা এখনো অনির্ধারিত। বিশ্লেষকদের মতে, উপসাগরীয় দেশগুলো গাজায় আন্তর্জাতিক বাহিনীর অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা দিতে পারে, তবে নিজেদের সেনা পাঠানোর বিষয়ে তারা সতর্ক।
অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মধ্যপ্রাচ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক টমাস জুনো বলেন, "লাগামহীন ইসরায়েল কী করতে পারে, এনিয়ে উপসাগরীয় দেশগুলো আশঙ্কা করছে। তবুও তারা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ছাতার ওপর নির্ভরশীল—এবং একইসঙ্গে ইরানের প্রভাব নিয়েও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।"