বিশ্বজুড়ে প্রতিভার অপচয়: ‘হারিয়ে যাওয়া আইনস্টাইনদের’ খুঁজবে কে?
স্কুলে পড়ার সময়েই আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে দুটি পদক জিতেছিলেন এরভিন ম্যাসিচ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে গবেষণা করেছেন, মডেলগুলো কীভাবে দ্রুত পূর্বাভাস দিতে পারে তা নিয়ে কাজ করেছেন। স্বপ্ন ছিল একদিন কোনো এআই ল্যাবে যোগ দিয়ে এই প্রযুক্তিকে নিরাপদ করে তুলবেন। কিন্তু ১৯ বছর বয়সী এই বসনীয় তরুণের পক্ষে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, সেখানকার বার্ষিক ফি ছিল ৬০ হাজার পাউন্ড, যা তার পরিবারের মোট বার্ষিক আয়ের পাঁচগুণ। ফলে তাকে সারায়েভো বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হতে হয়, যেখানে কয়েক দশক পুরোনো আইবিএম কম্পিউটারে বসে প্রোগ্রামিং পরীক্ষা দিতে হয়েছিল তাকে।
ম্যাসিচের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো উদাহরণ নয়। বিশ্বজুড়ে বিপুল পরিমাণ মেধা এভাবেই নষ্ট হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা এদের 'হারিয়ে যাওয়া আইনস্টাইন' বলে থাকেন, যাদের চিহ্নিত করা ও বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে তারা হয়তো যুগান্তকারী উদ্ভাবন করতে পারতেন।
এআইয়ের প্রতিযোগিতায় জিততে বিভিন্ন রাষ্ট্র সেমিকন্ডাক্টরের পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করলেও, যে মেধা এই অগ্রগতির চালিকাশক্তি, তাকেই উপেক্ষা করে। এজন্যই হয়ত এই খাতে গবেষক স্বল্পতার কারণে কিছু মুষ্ঠিমেয় বিশেষজ্ঞ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) সমান বেতন বাগিয়ে নেন।
অথচ মেধার পেছনে বিনিয়োগই দীর্ঘ মেয়াদে বেশি লাভজনক হতে পারত। তাহলে মেধা বিকাশে একটি কার্যকর 'শিল্পনীতি' কেমন হতে পারে?
বর্তমান শিল্পনীতির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন মেধা গড়ে তোলা নয়, বরং বিদ্যমান তারকা গবেষক বা বিশেষজ্ঞদের নিজেদের দলে টেনে নেওয়া।
সবচেয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। ২০০৮ সালে চালু হওয়া চীনের থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস প্ল্যান বিদেশে প্রশিক্ষিত নাগরিকদের দেশে ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছিল। এখন তারা বিশেষ 'কে ভিসা' চালু করছে, যাতে বিদেশি এসটিইএম বিশেষজ্ঞরাও আকৃষ্ট হন।
পাল্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এনেছে ও-১এ ভিসা ও ইবি-১এ গ্রিন কার্ড—যা দেওয়া হয় 'অসাধারণ যোগ্যতা'সম্পন্নদের।
জাপানও শীর্ষ গবেষকদের নিয়োগে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, তাদের 'চুজ ইউরোপ' প্রকল্প ইউরোপকে গবেষকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে।
কোম্পানিগুলোতেও একই প্রবণতা। যত বড় মডেল বানানোর প্রতিযোগিতা চলছে, ততই কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে বিলিয়ন ডলারের সমান সম্ভাবনার চাবিকাঠি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ওপেনএআই-এর প্রধান স্যাম অ্যাল্টম্যান একবার মজার ছলে বলেছেন, এমন কিছু অত্যন্ত দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার বা গবেষক আছেন—ধরা যাক '১০ হাজার গুণ বেশি উৎপাদনশীল'—যারা একাই পুরো একটি ক্ষেত্রের (যেমন এআই) অগ্রগতি বদলে দিতে পারেন। এর পর থেকে এই ধারণাটি শিল্পে প্রচলিত হয়ে গেছে; অর্থাৎ, কিছু নির্বাচিত ও অতি প্রতিভাবান ব্যক্তির অবদান এত গুরুত্বপূর্ণ যে, তাদের কাজ পুরো খাতের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন করতে পারে।
এই প্রতিযোগিতা মূলত দুটি ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমটি হলো, অল্পসংখ্যক প্রতিভাবান ব্যক্তি সিংহভাগ গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন বা গবেষণার অবদান রাখেন। অর্থাৎ, অল্পই তাদের কাজ পুরো ক্ষেত্রকে পরিবর্তন করতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো, এই ধরনের প্রতিভার সংখ্যা সীমিত।
প্রথম ধারণাটি শক্ত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দ্বিতীয়টি পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ বাস্তবে বহু প্রতিভার বিকাশের সুযোগ থাকে না। এর প্রথম বড় বাধা হলো ভৌগোলিক অবস্থান—অনেক মেধাবী শিশু বা তরুণ এমন অঞ্চলে জন্মায় যেখানে তাদের প্রতিভা চিহ্নিত বা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া কঠিন।
বিশ্বের ৯০ শতাংশ তরুণের বাস উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, অথচ নোবেল পুরস্কারের সিংহভাগই যায় আমেরিকা, ইউরোপ ও জাপানে।
জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যালেক্স বেল ও তার সহ-লেখকরা দেখেছেন, আমেরিকার শীর্ষ ১ শতাংশ ধনী পরিবারের শিশুদের উদ্ভাবক হওয়ার সম্ভাবনা মধ্যম আয়ের নিচের পরিবারের শিশুদের চেয়ে দশগুণ বেশি। তাদের মতে, আমেরিকায় শ্রেণি, লিঙ্গ এবং জাতিগত বৈষম্য দূর করা গেলে উদ্ভাবকের সংখ্যা চারগুণ বাড়বে, যা আবিষ্কারের গতিকে তীব্রভাবে বাড়িয়ে দেবে।
সরকারগুলো প্রতিভার সন্ধান কোথা থেকে শুরু করবে? একটি সহজ উত্তর হতে পারে একেবারে গোড়া থেকে—অর্থাৎ, আরও বেশি শিশুকে তাদের সক্ষমতা বিকাশের সুযোগ দেওয়া। সার্বজনীন পুষ্টি, উন্নত স্কুল এবং নিরাপদ পরিবেশ এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, মেধাবী প্রতিভা যেহেতু খুব বিরল, তাই এ ধরনের কর্মসূচিগুলোর লক্ষ্য নির্দিষ্ট থাকে না।
এক্ষেত্রে একটি বাস্তবসম্মত লক্ষ্য হতে পারে কৈশোর, যখন প্রতিভা প্রথম দৃশ্যমান হয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রুচির আগারওয়াল এবং ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাট্রিক গলের গবেষণা অনুযায়ী, গণিত অলিম্পিয়াডে দরিদ্র দেশগুলোর প্রতিযোগীরা ধনী দেশগুলোর প্রতিযোগীদের সমান স্কোর করলেও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাদের প্রকাশনা অনেক কম থাকে এবং শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের সম্ভাবনা মাত্র অর্ধেক থাকে।
খেলাধুলা প্রতিভা অনুসন্ধানের একটি চমৎকার উদাহরণ। ২০ শতকের গোড়ার দিকে বেসবলে 'ফার্ম সিস্টেম' চালু হয়, যেখানে ছোট শহর থেকে কিশোরদের বাছাই করে নিম্ন-স্তরের দলে প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় লিগের জন্য প্রস্তুত করা হয়। গত বছর ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশনে (এনবিএ) ৪০টিরও বেশি দেশ থেকে রেকর্ড ১২৫ জন আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় অংশ নেন, যা লিগের প্রায় এক চতুর্থাংশ। এর ফলে খেলোয়াড়দের মান ও বৈচিত্র্য উভয়ই বেড়েছে।
কিছু প্রতিভা সহজেই চোখে পড়ে। গত বছর ভারতের গুকেশ ডোম্মারাজু মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন হন। বাহামায় বেড়ে ওঠা ১৭ বছর বয়সী হানা কায়রো সম্প্রতি মিজোহাতা-তাকেউচি কনজেকচার নামে একটি গণিত সমস্যার সমাধান করে গণিতবিদদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের স্বর্ণপদক বিজয়ীদের মধ্যে প্রতি ৪০ জনে একজন বিজ্ঞানের বড় কোনো পুরস্কার অর্জন করেন, যা ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) স্নাতকদের হারের চেয়ে ৫০ গুণ বেশি। পাইথন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের স্রষ্টা গুইডো ভ্যান রসাম একজন ব্রোঞ্জ পদক বিজয়ী ছিলেন। ওপেনএআই-এর অর্ধেক প্রতিষ্ঠাতাই অলিম্পিয়াডে নিজেদের হাতেখড়ি দিয়েছেন।
প্রতিভা খুঁজে পাওয়া যথেষ্ট নয়; তাদের বিকাশের জন্যও সুযোগ তৈরি করতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক মেন্টর বা পরামর্শক।
হাঙ্গেরিতে জন্ম নেওয়া পলিম্যাথ জন ভন নিউম্যানকে নিবিড়ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তার পরামর্শক ছিলেন গণিতবিদ গ্যাবর সেগো।
সৌভাগ্যবশত, মেন্টরদের নিজেদের অবশ্য অত্যন্ত প্রতিভাশীল হওয়ার দরকার নেই। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ান ক্যালাওয়ের গবেষণা দেখায়, সাধারণ শিক্ষকরা যখন গণিত ক্লাব বা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন, অসাধারণ শিক্ষার্থীরা আরও সহজে চিহ্নিত হয়, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং গবেষণার পথ অনুসরণ করতে উৎসাহিত হয়।
প্রতিভাবানদের জন্য উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন সহকর্মীদের সঙ্গে সাহচর্যও প্রয়োজন। টমাস এডিসন নিউ জার্সিতে মেনলো পার্ক ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিলেন, যেখানে উদ্ভাবকরা একসঙ্গে কাজ করতে পারতেন। ভারতের তামিলনাড়ুতে দাবা এতটাই জনপ্রিয়, যে স্থানীয় প্রতিযোগিতা ও প্রশিক্ষণের কারণে এই রাজ্য দেশের অন্য যেকোনো জায়গার তুলনায় বেশি গ্র্যান্ডমাস্টার তৈরি করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও দাতব্য সংস্থার ভূমিকা
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধা বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হলেও তাদের অগ্রাধিকার ভিন্ন। বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি খুবই সীমিত। যেমন, ব্রিটেনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ২৪,০০০-এর বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর জন্য বছরে প্রায় ৬০০টি পুরস্কার দেয়। আমেরিকায় হার্ভার্ড, এমআইটি, প্রিন্সটন ও ইয়েলের মতো মুষ্টিমেয় কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সব খরচ বহন করে, কিন্তু সেখানেও প্রতি বছর মাত্র কয়েকশ শিক্ষার্থী এই সুবিধা পায়।
বর্তমানে মূলত সমাজসেবী এবং দাতব্য সংস্থাগুলোই প্রতিভা চিহ্নিত ও বিকাশে কাজ করছে। আগারওয়াল ও গলের প্রতিষ্ঠিত 'গ্লোবাল ট্যালেন্ট ফান্ড' বিশ্বজুড়ে অলিম্পিয়াড পদক বিজয়ীদের খুঁজে বের করে এবং শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের পড়াশোনার জন্য অর্থায়ন করে। তাদের প্রথম ব্যাচেই ছিলেন সেই বসনীয় তরুণ এরভিন ম্যাসিচ, যিনি এখন অক্সফোর্ডে গণিত ও কম্পিউটার সায়েন্স পড়ছেন। আরেকটি উদ্যোগ 'রাইজ' বিশ্বব্যাপী কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এবং বিজয়ীদের বৃত্তি, মেন্টরশিপ এবং উদ্যোগের জন্য অর্থায়ন করে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও আগামীর সম্ভাবনা
যেসব দেশ মেধা সনাক্ত ও সংগ্রহে সফল হয়, তারাই কৌশলগত প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকে। ম্যানহাটন প্রজেক্ট থেকে অ্যাপোলো মিশন পর্যন্ত আমেরিকার বৈজ্ঞানিক সাফল্য অনেকাংশে বিদেশি বিজ্ঞানীদের নিয়োগের ওপর নির্ভরশীল ছিল। শুধু 'অপারেশন পেপারক্লিপ' এর মাধ্যমেই ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে ১,৫০০-এর বেশি জার্মান গবেষক আমেরিকায় আনা হয়েছিল।
চীনের অবস্থানও উল্লেখযোগ্য। তারা বর্তমানে আমেরিকার তুলনায় অনেক বেশি বিজ্ঞান স্নাতক উৎপন্ন করছে এবং বিশ্বের শীর্ষ এআই গবেষকদের এক চতুর্থাংশ তৈরি করছে। তবে সেরা প্রতিভাদের অনেকেই ডক্টরাল প্রশিক্ষণ এবং চাকরির জন্য বিদেশের দিকে চলে যান।
এর গুরুত্ব কেবল ভূ-রাজনৈতিক নয়। প্রতিভার বিকাশের পথে বাধা দূর করা গেলে বিশ্বে উদ্ভাবকের সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। এই সম্ভাবনা কাজে লাগালে নতুন ওষুধ আবিষ্কার, সবুজ জ্বালানিতে রূপান্তর এবং এআই-অগ্রগতি দ্রুততর হবে। ফলে মানুষ জীবনযাত্রায় আরও স্বাস্থ্যকর, পরিচ্ছন্ন ও সমৃদ্ধ হবে। অপচয় হওয়া প্রতিভা আজ বিশ্বের সবচেয়ে অবহেলিত সম্ভাবনার চালিকাশক্তি।
