মার্কিন হামলায় ইরানের পারমানবিক স্থাপনা 'সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়নি'—বলছে নতুন গোয়েন্দা প্রতিবেদন

গত মাসে ইরানে বোমা হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি 'সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস' হয়ে গেছে। তবে সে দাবি নিয়ে আবারও প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন গোয়েন্দারা।
মার্কিন গোয়েন্দাদের বরাতে ওয়াশিংটন পোস্ট ও এনবিসি নিউজ-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনটি লক্ষ্যবস্তু স্থাপনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র শুধু ফোরদো কেন্দ্রটিকে ধ্বংস করতে পেরেছে। তবে এই কেন্দ্রেও সব সেন্ট্রিফিউজ ধ্বংস হয়েছে কি না, নাকি হামলার আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
'আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে পুরো কর্মসূচি ধ্বংস হয়েছে,' ওয়াশিংটন পোস্ট-কে বলেন এক মার্কিন কর্মকর্তা।
অন্যদিকে ট্রাম্প তার অবস্থানে অনড়। তিনি এসব হামলাকে 'চমৎকার সাফল্য' হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং যেসব রিপোর্ট এই সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, সেগুলোকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
হামলার পর ফাঁস হওয়া একটি প্রাথমিক গোয়েন্দা মূল্যায়নে বলা হয়েছিল, এই হামলা ইরানের পরমাণু কর্মসূচির মূল অংশ ধ্বংস করতে পারেনি—শুধু কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে। যদিও জুলাইয়ের শুরুতে পেন্টাগন জানিয়েছিল, এই হামলায় ইরানের কর্মসূচি ১ থেকে ২ বছর পিছিয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ফোরদো কেন্দ্রকে এতদিন সবচেয়ে সুরক্ষিত ধরা হলেও নাতাঞ্জ ও ইসফাহানেও রয়েছে গভীর ভূগর্ভস্থ টানেল—যা আগে তেমনভাবে আলোচনায় আসেনি।
'অভেদ্য' স্থাপনাগুলো
ইসফাহানের মতো স্থানে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের বাঙ্কার-বাস্টার বোমা ব্যবহার করেনি। বরং সেখানকার ওপরের কাঠামোতেই হামলা চালানো হয়।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, কংগ্রেসের এক সহযোগী, যিনি গোয়েন্দা ব্রিফিং সম্পর্কে অবগত, বলেছেন—পেন্টাগনের মূল্যায়ন অনুযায়ী ইসফাহানের ভূগর্ভস্থ স্থাপনাগুলো 'প্রায় অভেদ্য'।
তবে পেন্টাগন পুনরায় জোর দিয়ে বলেছে, তিনটি লক্ষ্যবস্তুই 'সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস' করা হয়েছে।
ইসরায়েল, যারা গত মাসে ইরানের বিরুদ্ধে 'অপ্ররোচিত' হামলা চালিয়ে যুদ্ধের সূচনা করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নকে সমর্থন করেছে। একইসঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছে—তেহরান পরমাণু কর্মসূচি আবার চালু করলে তারা আরও হামলা চালাবে।
তেহরান নিজে এখনো পরমাণু স্থাপনাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি। যদিও কিছু ইরানি কর্মকর্তা বলছেন, মার্কিন ও ইসরায়েলি হামলায় কেন্দ্রগুলো মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে। তবে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, ট্রাম্প হামলার প্রভাব 'বাড়িয়ে বলছেন'।
এখনো অজানা রয়ে গেছে—ইরানের উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম কোথায় রাখা হয়েছে এবং সেগুলোর অবস্থা কী।
তবে ইরানের পারমাণবিক সংস্থা এবং আশপাশের দেশগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে, হামলার পর আশপাশে তেজস্ক্রিয়তা বাড়ার কোনো আলামত তারা পায়নি। অর্থাৎ, ইউরেনিয়াম ছড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটেনি।
তবুও জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএ-এর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি সিবিএস নিউজ-কে বলেন, ইউরেনিয়াম রাখা পাত্রগুলো আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে।
তিনি আরও জানান, ইরান চাইলে 'কয়েক মাসের মধ্যেই' ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম আবার শুরু করতে পারবে।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ
গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের ওপর ব্যাপক বিমান হামলা চালায়, এতে ইরানের একাধিক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। যুদ্ধে সামরিক ঘাঁটি ছাড়াও বেসামরিক অবকাঠামো ও আবাসিক এলাকাও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এতে শত শত সাধারণ নাগরিক নিহত হন।
এর পাল্টা জবাবে ইরানও ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং অন্তত ২৯ জনের প্রাণহানি ঘটে।
যুক্তরাষ্ট্রের যুক্ত হওয়া এবং কাতারে পাল্টা হামলা
২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সহায়তা করে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায়। এর জবাবে ইরান ২৩ জুন কাতারে অবস্থিত আল উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যেখানে মার্কিন সেনারা অবস্থান করছিল।
প্রথমে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, ইরানের সব ক্ষেপণাস্ত্রই প্রতিহত করা হয়েছে। তবে স্যাটেলাইট ছবিতে ঘাঁটির ক্ষতি দেখা যাওয়ার পর পেন্টাগন স্বীকার করে—একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত হয়নি।
পেন্টাগনের মুখপাত্র শন পারনেল আল জাজিরা-কে এক ইমেইলে জানান, '২৩ জুন একটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আল উদেইদ ঘাঁটিতে আঘাত হানে। তবে বাকি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মার্কিন ও কাতারি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফলভাবে থামিয়ে দেয়। হামলায় ঘাঁটির কিছু যন্ত্রপাতি ও স্থাপনার সামান্য ক্ষতি হয়েছে, তবে কেউ আহত হয়নি।'
১২ দিন ধরে চলা এই সংঘর্ষ শেষে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান উভয়েই পরমাণু ইস্যুতে কূটনৈতিক সমাধানের কথা জানায়। তবে এখনো কোনো আলোচনা শুরু হয়নি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা এবং ফের আলোচনার সম্ভাবনা
ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরুর আগে পর্যন্ত ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র পর্যায়ক্রমে পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রকে ২০১৫ সালের বহুপাক্ষিক পরমাণু চুক্তি—জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন থেকে সরিয়ে নেন। এই চুক্তির আওতায় ইরান তার পরমাণু কার্যক্রম সীমিত করার বিনিময়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি পায়।
সম্প্রতি ইউরোপীয় কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইরান চুক্তি লঙ্ঘন করছে—এই যুক্তিতে তারা 'স্ন্যাপ-ব্যাক' নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন। তবে তেহরান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম চুক্তি ভেঙেছে এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে তাদের অধিকার এই চুক্তিতে স্বীকৃত।
শুক্রবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিকের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
আরাঘচি বলেন, ইউরোপের উচিত 'হুমকি ও চাপের পুরনো নীতি' পরিহার করা। সামাজিক মাধ্যমে তিনি লিখেন, '২০১৫ সালে দুই বছর ধরে আলোচনা করে চুক্তিটি করা হয়েছিল—তাতে থেকে সরে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান নয়। আবার এ বছর জুন মাসেও আলোচনার টেবিল ছেড়ে সামরিক পথ বেছে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান নয়।'
তিনি আরও বলেন, 'যেকোনো নতুন আলোচনা শুরু হতে পারে তখনই, যখন অন্য পক্ষ ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ এবং পারস্পরিকভাবে লাভজনক সমঝোতার জন্য প্রস্তুত থাকবে।'
তেহরান বারবার দাবি করেছে, তারা পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে চায় না। অন্যদিকে ইসরায়েল নিজেই কোনোদিন পরমাণু অস্ত্রের অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও, দেশটির কাছে গোপন পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।