আয়ু বাড়ানোর ওষুধ কি সত্যিই কার্যকর?

যদি জিজ্ঞেস করা হয় 'দীর্ঘজীবনের রহস্য কী?'—প্রশ্নটির উত্তর একেক জনের কাছে একেক রকম।
সাধারণত আমরা ভাবি সুস্থ জীবনধারা আর সঠিক খাদ্যাভ্যাসই তার মূল চাবিকাঠি। নিজের দীর্ঘ জীবনের রহস্য জানতে চাইলে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের ১১৫ বছর বয়সী ইথেল বলেন, সবসময় সবার সাথে তর্ক এড়িয়ে চলার কারণেই বর্তমানে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি।
কিছু গবেষক মনে করেন, মানসিক সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য দীর্ঘায়ুর জন্য অপরিহার্য। আবার জাপানিদের কাছে দীর্ঘায়ুর মূল রহস্য 'ইকিগাই' অর্থাৎ ব্যস্ত ও অর্থবোধপূর্ণ জীবনযাপন।
তবে যদি বলি, দীর্ঘায়ুর মূল চাবিকাঠি হতে পারে উপবাস—অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ধরে না খাওয়া?
শুনতে হয়তো একটু অবাক লাগতে পারে—সাধারণত ধর্মীয় কারণে উপবাস কিংবা ওজন কমানোর উদ্দেশ্যে 'ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং'(দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকা) করা হয়। কিন্তু দীর্ঘজীবনের জন্য এই ধরনের উপবাসের কথা তো আগে কেউ ভাবেনি। তবে, এই ধারণার পক্ষে গবেষণায় বেশ কিছু শক্ত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
নানা প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, কম খাওয়া বা প্রায় অনাহার অবস্থায় রাখলে তাদের আয়ু বেড়ে যায়। কৃমি থেকে শুরু করে বানর পর্যন্ত বারবার এই ফলাফল নিশ্চিত হয়েছে।
মানুষের ক্ষেত্রে এটি নিয়ে এখনও কোনও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা হয়নি, তবে স্বল্পমেয়াদি বেশ কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে যে মানুষের শরীরেও একই ধরনের পরিবর্তন ঘটে। তবে বাস্তবে দীর্ঘায়ুর আশায় কয়জনই বা তিন বেলা খাবার ছাড়তে রাজি হবেন!
সেজন্য বিজ্ঞানীরা এমন কোনও ওষুধ খুঁজছেন, যা উপবাসের বা না খেয়ে থাকার মতো উপকারে শরীরকে সাহায্য করতে পারে। এই খোঁজে বিশেষ আলোচনায় এসেছে দুটি ওষুধ—'র্যাপামাইসিন' এবং 'মেটফর্মিন'।
কিডনি প্রতিস্থাপনের পর অনেক সময় শরীর নতুন কিডনিকে নিজের অঙ্গ হিসেবে মেনে নিতে চায় না। তখন শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা সেটাকে বহিরাগত মনে করে আক্রমণ করতে পারে। র্যাপামাইসিন এই প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়াকে দমন করে, যাতে নতুন কিডনি ঠিকভাবে কাজ করতে পারে। আর এদিকে, মেটফর্মিন বহুদিন ধরে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত একটি ওষুধ।
এই দুই ওষুধ আসলেই উপবাসের বিকল্প হতে পারে কি না, বা কতটা কার্যকর— তা নিয়ে প্রাণীদের ওপর চালানো বিভিন্ন পরীক্ষার তথ্য পর্যালোচনা করে গত ১৯ জুন একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।

দীর্ঘজীবনের আশায় যারা বিভিন্ন উপায় খুঁজছেন, তাদের আগ্রহের কেন্দ্রে এখন র্যাপামাইসিন ও মেটফর্মিন। এই ওষুধগুলো শরীরের 'মেকানিস্টিক টার্গেট অফ র্যাপামাইসিন' (এমটিওআর) নামের একটি রাসায়নিক পথকে নিয়ন্ত্রণ করে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পথ অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে পড়ে, যা শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ বার্ধক্যের নানা লক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে উপবাস করা এমটিওআর-এর কাজ কমিয়ে দেয়। এতে কোষ 'অটোফ্যাজি' প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের ভেতরের জমে থাকা বর্জ্য পরিষ্কার করে ফেলে—যা শরীর ভালো রাখে ও আয়ু বাড়ায়।
র্যাপামাইসিন ও মেটফর্মিন—দুটোরই আরেকটি বড় সুবিধা হলো, এগুলো বহু আগেই নিরাপদ হিসেবে পরীক্ষিত এবং অনুমোদিত। পাশাপাশি, এখন এগুলো পেটেন্টমুক্ত হওয়ায় তুলনামূলকভাবে অনেক সস্তাও।
তবে ওষুধগুলো পেটেন্টমুক্ত হওয়ায় মানুষের ওপর পরীক্ষা চালাতে বড় ওষুধ কোম্পানিগুলোর তেমন একটা আগ্রহ নেই। কারণ তারা এসব ওষুধ থেকে একচেটিয়া লাভ করার সুযোগ পায় না।
মেটফর্মিন নিয়ে দীর্ঘায়ু পরীক্ষার একটি বড় পরিকল্পনা ছিল 'টেইম' (TAME), যা আমেরিকার খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) অনুমোদনও পেয়েছিল। কিন্তু অর্থের অভাবে সেটি শুরুই করা যায়নি।
অন্যদিকে, র্যাপামাইসিন নিয়ে 'পার্ল' (PEARL) নামে আরেকটি পরীক্ষা ২০২০ সালে শুরু হয়। তবে সেখানেও এখন পর্যন্ত ওষুধটি সত্যিই আয়ু বাড়াতে পারে এমন কোনও শক্ত কোনো প্রমাণ মেলেনি।
তবে প্রাণীদের ওপর চালানো পরীক্ষার ফলাফল তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এডওয়ার্ড আইভিমি-কুক ও তার সহকর্মীরা সম্প্রতি 'এজিং সেল' জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় মাছ থেকে বানর পর্যন্ত আট ধরনের প্রাণীর ওপর চালানো ১৬৭টি পরীক্ষা বিশ্লেষণ করেছেন। দেখা গেছে—উপবাস বা ক্যালোরি কমানো আয়ু বাড়াতে কার্যকর। প্রায় একইভাবে কাজ করেছে র্যাপামাইসিনও। কিন্তু মেটফর্মিন সে ফল দিতে পারেনি।
মেটফর্মিনে আশাবাদী যারা, তাদের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা। অনেকেই দীর্ঘ জীবনের আশায় চিকিৎসকের কাছ থেকে এই ওষুধ 'অফ-লেবেল' প্রেসক্রিপশনে সংগ্রহ করেছেন।
বিপরীতে, র্যাপামাইসিন গ্রহণকারীদের জন্য গবেষণার ফল কিছুটা স্বস্তির। এর মধ্যে আছেন সিলিকন ভ্যালির বিনিয়োগকারী বিনোদ খোসলা এবং ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্যোক্তা ব্রায়ান জনসন, যিনি 'অনন্তজীবনের' খোঁজে দ্বিতীয় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। তবে রক্তে চর্বি ও চিনির মাত্রা বেড়ে যাওয়া, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি এবং ত্বকে সংক্রমণের ঝুঁকি—এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে জনসন ২০২৪ সালে ওষুধটি বন্ধ করে দেন।
সব মিলিয়ে, এই সকল তথ্য আগ্রহউদ্দীপক শোনালেও সাধারণ মানুষের দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের মূলমন্ত্র আজও একই: পরিমিত খাওয়া ও পানি পান করা, নিয়মিত ব্যায়াম, ভালো ঘুম—এবং ধূমপান ছেড়ে দেওয়া।