ইউক্রেনে রুশ সামরিক বাহিনীর নতুন অগ্রগতি দাবি, তবে অস্বীকার করছে ইউক্রেন

প্রথমবারের মতো রুশ বাহিনী ইউক্রেনের দিনিপ্রোপেট্রোভস্ক অঞ্চলে প্রবেশ করেছে বলে দাবি করছে রাশিয়া। এই অঞ্চলটি তারা দীর্ঘদিন ধরেই দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল।
এমন অগ্রযাত্রা ইউক্রেনীয় বাহিনীর ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, তাদের ৯০তম ট্যাংক ডিভিশনের কয়েকটি ইউনিট দোনেৎস্ক ও দিনিপ্রোপেট্রোভস্ক অঞ্চলের সীমান্তে পৌঁছায়। এরপর তারা দিনিপ্রোপেট্রোভস্কের ভেতরে অগ্রসর হয়।
তবে এই অগ্রগতির প্রকৃত মাত্রা কিংবা রাশিয়ার উদ্দেশ্য কী, তা এখনও স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানায়, যুদ্ধক্ষেত্রের এসব তথ্য তারা যাচাই করতে পারেনি।
তবে ইউক্রেন সরকার রাশিয়ার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইউক্রেনীয় খোর্তিতসিয়া বাহিনীর মুখপাত্র ভিকটর ত্রেহুবোভ বলেন, 'রুশ বাহিনী বারবার মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে যে তারা পোকরোভস্ক ও নোভোপাভলিভকা দিক দিয়ে দিনিপ্রোপেট্রোভস্কে প্রবেশ করেছে। কিন্তু এই দুই দিকেই এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি।'
তবে যদি রাশিয়ার দাবি সত্য হয়, তাহলে তা হবে ইউক্রেনের জন্য এক নতুন ধাক্কা—বিশেষ করে এখন যখন শান্তি আলোচনা কার্যত স্থগিত রয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহে রুশ বাহিনী উত্তরাঞ্চলীয় সুমি ও দোনেৎস্কের লাইমান এলাকায় ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে রুশ হামলার মুখে থাকা কৌশলগত শহর পোকরোভস্ক নিয়েও নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে।
ইউক্রেন সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফ রোববার সকালে জানায় , পোকরোভস্কমুখী ৬৫টি রুশ হামলা প্রতিহত করেছে তাদের বাহিনী।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা 'ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার' (আইএসডব্লিউ) জানায়, শনিবার রুশ বাহিনী পোকরোভস্কমুখী আক্রমণ অব্যাহত রাখলেও সেদিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
ইউক্রেনীয় বিশ্লেষণ সংস্থা 'ডিপ স্টেট'-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এলাকা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। এর মধ্যে রয়েছে ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া ও পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসনের আগেই দখলে নেওয়া ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের কিছু এলাকা।
রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের উপ-চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, ইস্তানবুলে শান্তি আলোচনায় ইউক্রেন রুশ দখলকৃত অঞ্চলগুলোকে স্বীকৃতি না দেয়ায় দিনিপ্রোপেট্রোভস্ক অঞ্চলে অভিযান জোরদার করেছে মস্কো।
টেলিগ্রামে দেওয়া এক বার্তায় মেদভেদেভ লিখেছেন, 'যারা আলোচনায় যুদ্ধের বাস্তবতা স্বীকার করতে চায় না, তাদের জন্য আমরা যুদ্ধের ময়দানেই নতুন বাস্তবতা তৈরি করব।'
দিনিপ্রোপেট্রোভস্ক অঞ্চলটি দোনেৎস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া—এই তিনটি রুশ-অংশদখলকৃত অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত। রাশিয়া এর আগেই ঘোষণা করেছে—পুরো দোনেৎস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া দখল করা তাদের অন্যতম লক্ষ্য। এ ছাড়া লুহানস্ক অঞ্চলের প্রায় পুরোটা ইতোমধ্যেই রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে।
তবে তুলনামূলকভাবে গ্রামীণ ও কম জনবসতিপূর্ণ দিনিপ্রোপেট্রোভস্ক অঞ্চল ইউক্রেনের জন্য প্রতিরক্ষা জোরদার করা কঠিন হতে পারে। অঞ্চলটি গুরুত্বপূর্ণ খনি ও লজিস্টিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। যুদ্ধ শুরুর আগে এখানে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের বসবাস ছিল।
রাশিয়ার নতুন অগ্রগতির এই দাবির কয়েক দিন আগেই রুশ বাহিনী উত্তরাঞ্চলীয় সুমি অঞ্চলে অগ্রসর হয়ে শহরটি ড্রোন ও কামানের আওতায় চলে এসেছে। যদিও শহরটি দখলের পরিকল্পনা রাশিয়ার নেই বলেই ধারণা করা হচ্ছে, তবে এতে বোঝা যাচ্ছে—উত্তর সীমান্ত থেকে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত পুরো ফ্রন্টজুড়ে মারাত্মক চাপে আছে ইউক্রেন।
বন্দি বিনিময় ব্যর্থ, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রাশিয়া-ইউক্রেনের
এদিকে, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অগ্রগতির মধ্যেই গত শনিবার নির্ধারিত বন্দি বিনিময় বাতিল হওয়ায় নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে।
রাশিয়ার অভিযোগ, যুদ্ধবন্দি ও নিহত সেনাদের মরদেহ বিনিময়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন থাকলেও ইউক্রেন হঠাৎ প্রক্রিয়া স্থগিত করে। তাদের দাবি, শত শত ইউক্রেনীয় সেনার মরদেহসংবলিত রেফ্রিজারেটেড ট্রাক বিনিময় কেন্দ্রে অপেক্ষায় থাকলেও কিয়েভ শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ায়।
তবে ইউক্রেন এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা জানায়, শনিবার গুরুতর আহত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক সৈন্যদের বিনিময়ের বিষয়ে দুই দেশ সম্মত হলেও নিহতদের মরদেহ ফেরত দেওয়ার জন্য এখনো নির্দিষ্ট কোনো তারিখ ঠিক হয়নি।
এর আগে সোমবার ইস্তানবুলে শান্তি আলোচনার দ্বিতীয় পর্যায়ে এ সপ্তাহেই বন্দি বিনিময়ের বিষয়ে একমত হয়েছিল রাশিয়া ও ইউক্রেন।
ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান কিরিলো বুদানভ বলেন, 'আমরা ইস্তানবুলে হওয়া সব চুক্তি মেনে চলছি। নিহতদের মরদেহ ফেরতের প্রক্রিয়া আগামী সপ্তাহে শুরু হবে।'
ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি ও নিহত সেনাদের মরদেহ ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দুঃখ প্রকাশ করে জানান, 'ইস্তানবুলে যে এক হাজারেরও বেশি সেনা বিনিময়ে আমরা সম্মত হয়েছিলাম, তাদের পূর্ণ তালিকা এখনো রাশিয়ার পক্ষ থেকে আসেনি।'
'যেন দুই শিশু পার্কে পাগলের মতো মারামারি করছে': ট্রাম্প
ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের তীব্রতা বাড়ছে। ইউক্রেন রুশ ভূখণ্ডে ড্রোন হামলা চালিয়ে একাধিক সামরিক বিমান ধ্বংস করেছে। পাশাপাশি ক্রিমিয়া সেতুতে পানির নিচে বিস্ফোরক স্থাপন করে আক্রমণ চালিয়েছে।
সোমবার ইস্তানবুলে দ্বিতীয় দফা শান্তি আলোচনায় অংশ নেয় দুই দেশের প্রতিনিধি দল। অবশ্য মাত্র এক ঘণ্টার এই আলোচনায় বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি। সমালোচকরা বলছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শান্তি আলোচনা দীর্ঘায়িত করে সময় নষ্ট করছেন, যাতে বেশি ভূখণ্ড দখল করতে পারেন।
পুতিন ৩০ দিনের শর্তহীন যুদ্ধবিরতিতে রাজি নন। তিনি সীমিত কিছু এলাকায় দুই-তিন দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছেন।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া ও ইউক্রেনকে সতর্ক করে বলেছেন, তার শান্তি উদ্যোগে ব্যর্থ হলে এর 'পরিণতি' ভোগ করতে হবে। তবে তিনি এখনও রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা চাপানোর ব্যাপারে বিরত রয়েছেন, যদিও রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট—উভয় দল থেকেই তার ওপর চাপ বাড়ছে।
ট্রাম্প যুদ্ধরত দেশ দুইটিকে শিশুদের মারামারির সঙ্গে তুলনা করে বলেন, 'কখনো কখনো তাদের লড়তে দেওয়া ভালো, তারপর টেনে আলাদা করতে হবে।' তিনি বলেন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় নির্ধারণ করা তার হাতে এবং প্রয়োজনে উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প।