ট্রাম্প জুনিয়রের পৃষ্ঠপোষকতায় লাস ভেগাসে শুরু হচ্ছে বিশ্বের প্রথম ডোপিং অনুমোদিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা

লাস ভেগাসে শুরু হতে যাচ্ছে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা 'এনহ্যান্সড গেমস'। আগামী বছরের মার্চে 'রিসোর্টস ওয়ার্ল্ড'-এ শুরু হতে যাওয়া এই প্রতিযোগিতা ঘিরে এখনই শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশ্বের সব শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়া ইভেন্টে পারফরমেন্স (সক্ষমতা) বৃদ্ধিকারক ওষুধ ও থেরাপি নিষিদ্ধ হলেও লাস ভেগাসের এ প্রতিযোগিতায় এসবের ব্যবহার শুধু অনুমোদিতই নয়, বরং উৎসাহিত করা হবে।
আয়োজকদের দাবি, এটি 'খেলাধুলা ও বিজ্ঞানের এক নতুন যুগের সূচনা'।
'এনহ্যান্সড গেমস'-এর প্রথম আসর অনুষ্ঠিত হবে ২১ থেকে ২৪ মে ২০২৬ পর্যন্ত। চার দিনব্যাপী এই গেমসে অ্যাথলেটরা দৌড়, ওজন উত্তোলন ও সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন।
আয়োজনের প্রচারপত্রে বলা হয়েছে, 'আমরা এক নতুন ধরনের মানব শ্রেষ্ঠত্বের সূচনা করছি। এমন একটি জগৎ, যেখানে সক্ষমতাবর্ধক ওষুধ ব্যবহৃত হবে নিরাপদ, খোলামেলা ও চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে।' আয়োজকদের যুক্তি, বর্তমান ডোপিংবিরোধী নীতিমালা অপ্রাসঙ্গিক ও ভণ্ডামিপূর্ণ। তাই তারা এমন একটি ক্রীড়ামঞ্চ তৈরি করতে চান, যেখানে ওষুধের ব্যবহার হবে স্বাভাবিক, পরীক্ষিত ও স্বচ্ছ।
খেলোয়াড়দের জন্য তিনটি পথ খোলা থাকবে—তারা চাইলে প্রাকৃতিকভাবে কোনো ওষুধ গ্রহণ না করেই প্রতিযোগিতা করতে পারেন, চাইলে নির্দিষ্ট একটি ওষুধ ব্যবহারের নিয়ম অনুসরণ করতে পারেন, আবার চাইলে যুক্ত হতে পারেন চিকিৎসাগত পর্যবেক্ষণে থাকা কোনো পরীক্ষামূলক ওষুধ ব্যবহারের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে।
এনহ্যান্সড গেমসের প্রতিষ্ঠাতা, লন্ডনভিত্তিক অস্ট্রেলীয় উদ্যোক্তা অ্যারন ডি'সুজা বলেন, 'আমরা অলিম্পিক মডেলকে ২১ শতকের জন্য পুনর্গঠন করছি। বিজ্ঞানের এই গতিময় যুগে খেলাধুলাকেও এগিয়ে যেতে হবে।'
খেলোয়াড়দের জন্য থাকছে বিস্তৃত মেডিকেল স্ক্রিনিং, স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং স্বতন্ত্র বৈজ্ঞানিক ও নৈতিক বোর্ডের তত্ত্বাবধান। তবে প্রচলিত ডোপিং পরীক্ষা এখানে থাকবে না; খেলোয়াড়রা নিজেরাই জানিয়ে দেবেন, তারা কী ধরনের ওষুধ ব্যবহার করছেন।
প্রতিযোগিতার পুরস্কারও যথেষ্ট আকর্ষণীয়—প্রতিটি ইভেন্টে ৫ লাখ ডলার পর্যন্ত পুরস্কার, আর ১০০ মিটার স্প্রিন্ট বা ৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে বিশ্ব রেকর্ড ভাঙলে মিলবে ১০ লাখ ডলারের বোনাস।
সম্প্রতি গ্রিক-বুলগেরীয় সাঁতারু ক্রিশিয়ান গোলোমেয়েভ ৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইল ২০.৮৯ সেকেন্ড সময় নেন, যা তার ২০০৯ সালের বিশ্ব রেকর্ডের চেয়ে ০.০২ সেকেন্ড কম। তবে বিতর্ক এখানেও—গোলোমেয়েভ একটি পলিউরেথিন সাঁতারের স্যুট পরেছিলেন, যা আন্তর্জাতিক সাঁতার সংস্থা ফিনা অনুমোদন করেনি।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এর মধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ওয়ার্ল্ড অ্যান্টি-ডোপিং এজেন্সি এক বিবৃতিতে বলেছে, 'পেছনের ইতিহাস বলছে, সক্ষমতাবর্ধক ওষুধ বহু খেলোয়াড়ের শরীর ও মনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে—কেউ কেউ প্রাণও হারিয়েছেন। এই ইভেন্ট সেই ঝুঁকিকেই উসকে দিচ্ছে।'
আরও কঠিন ভাষায় সমালোচনা করেছেন ইউএস অ্যান্টি-ডোপিং এজেন্সির প্রধান ট্রাভিস টাইগার্ট। তিনি বলেন 'এটা আসলে একটা বিপজ্জনক সার্কাস, খেলাধুলা নয়।'
'এনহ্যান্সড গেমস' শুধু ডোপিং বৈধ করার ঘোষণার জন্য নয়, বরং এর পৃষ্ঠপোষকদের কারণেও ব্যাপক আলোচনায় এসেছে। সাম্প্রতিক বিনিয়োগ রাউন্ডে এই আয়োজনের পেছনে যুক্ত হয়েছে কোটি কোটি ডলারের তহবিল, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র, ওমিদ মালিক এবং ক্রিস বাসকার্ক—তিনজনই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক অঙ্গনের পরিচিত মুখ।
এছাড়া, সহ-নেতৃত্বে রয়েছে অ্যাপেইরন ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ ও কারাটেজ, যারা ক্রিপ্টোকারেন্সি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রকল্পে বিনিয়োগ করে থাকে।
এই বিনিয়োগের ঘোষণা ঘিরে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, যা আয়োজনটিকে আরও বিতর্কিত করে তুলেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পপন্থী বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ততাকে স্বাভাবিক বলেই মনে করেন ইনহান্সড গেমসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যারন ডি'সুজা। ফেব্রুয়ারিতে তিনি বলেন, 'আমি প্রশাসনের অনেক সদস্য এবং ট্রাম্প আন্দোলনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য পেয়েছি। আমেরিকার সমাজ ও রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তি এনহান্সড গেমসকে সমর্থন করছেন—এটি আমাদের জন্য যে কোনো বিনিয়োগের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।'
টেক-বিলিয়নেয়ার পিটার থিয়েলও এই প্রকল্পের অন্যতম বিনিয়োগকারী ও 'ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা' হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের লিবার্টারিয়ান রাজনীতির পরিচিত মুখ। তার অতীতের বিতর্কিত বায়োটেক উদ্যোগ এই প্রকল্পকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
তবে আয়োজকরা বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য অলিম্পিক রেকর্ড বাতিল করা নয়, বরং একটি সমান্তরাল প্রতিযোগিতা তৈরি করা—যেমনটি হয়েছিল পেশাদার ক্রীড়ার প্রবর্তনের সময়। তারা চায়, মানব সামর্থ্যের সীমানা অন্বেষণ করতে এবং বৃহত্তর সাংস্কৃতিক বিতর্ক উসকে দিতে।
এনহ্যান্সড গেমস এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খেলোয়াড়দের আহ্বান জানাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সাঁতারু জেমস ম্যাগনুসেন এই প্রকল্পে যুক্ত হলেও এখনও রেকর্ড ভাঙতে পারেননি।
নিউইয়র্ক-ভিত্তিক আয়োজকরা বলছেন, নিষিদ্ধ মাদক ব্যবহারের অপব্যবহার বরদাস্ত করা হবে না। প্রতিযোগীদের ওষুধগুলো অবশ্যই বৈধভাবে প্রেসক্রিপ্টেড হতে হবে এবং তাদের শারীরিকভাবে ফিট থাকতে হবে। তবে, তত্ত্বাবধানের চেয়ে অংশীদারিত্বকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এনহান্সড গেমস—এটি তাদের মতে দুর্বলতা নয়, বরং কৌশল।
গেমসটির একটি অভ্যন্তরীণ প্রশ্নোত্তরে লেখা আছে, 'অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় সব সময়ই ঝুঁকি থাকে। আমরা মনে করি, সেই ঝুঁকির অস্তিত্ব অস্বীকার করাটাই আসল ঝুঁকি।'
তবে এই যুক্তি সাধারণ মানুষ গ্রহণ করবে কিনা, তা এখনো অনিশ্চিত। আয়োজকেরা বড় স্পন্সর এবং স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে আলোচনার কথা বললেও এখনো কোনো সম্প্রচার পার্টনার বা জনপ্রিয় খেলোয়াড়ের নাম ঘোষণা করা হয়নি, কয়েকজন প্রাথমিক অংশগ্রহণকারী ছাড়া।
যদি ক্রীড়া ফেডারেশন, সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার দিক থেকে বৃহত্তর প্রতিক্রিয়া আসে—তাহলে এই উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ হয়তো শুরুর আগেই মুখ থুবড়ে পড়বে।
তবু আয়োজকেরা এগিয়ে যাচ্ছেন তাদের দৃঢ় স্লোগান নিয়ে—'লিভ এনহ্যান্সড'।