যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনা চায় ইরান, হামলায় না জড়াতে আঞ্চলিক দেশগুলোকে হুঁশিয়ারি

যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে সরাসরি পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা কিংবা বোমাবর্ষণের হুমকি—কোনোটিই আমলে নিচ্ছে না ইরান। বরং তারা প্রতিবেশী দেশগুলোকে সতর্ক করে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করে, তবে এসব ঘাঁটিও হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। একজন ঊর্ধ্বতন ইরানি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এসব তথ্য জানান।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও ওমানের মাধ্যমে পরোক্ষ সংলাপ চালিয়ে যেতে আগ্রহী। ওমান দীর্ঘদিন ধরেই এই দুই দেশের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, 'পরোক্ষ সংলাপ ইরানের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানে ওয়াশিংটনের আন্তরিকতা পরখ করার একটি সুযোগ এনে দিতে পারে।'
কর্মকর্তা বলেন, এ পথটি হয়ত 'কঠিন' হতে পারে, তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি ইতিবাচক বার্তা পাঠায়, তাহলে শিগগিরই এ ধরনের আলোচনা শুরু হতে পারে।
ওই কর্মকর্তা জানান, ইরান ইতোমধ্যে ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, তুরস্ক ও বাহরাইনের কাছে বার্তা পাঠিয়ে সতর্ক করেছে—যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের ওপর হামলা চালানোর জন্য এসব দেশের আকাশসীমা কিংবা ভূখণ্ড ব্যবহার করে, তবে তা শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করা হবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, 'এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ তাদের জন্য গুরুতর পরিণতি ডেকে আনবে।' তিনি আরও জানান, সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইতোমধ্যে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
গাজা ও লেবাননে প্রকাশ্য যুদ্ধ, ইয়েমেনে সামরিক হামলা, সিরিয়ায় নেতৃত্বে পরিবর্তন এবং ইসরায়েল-ইরান গোলাগুলির প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর হুঁশিয়ারি অঞ্চলজুড়ে বিদ্যমান উত্তেজনাকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
ফলে পারস্য উপসাগর ঘিরে বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে একটি বৃহত্তর সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উপসাগরের এক পাশে ইরান, আর অপর পাশে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত আরব রাজতন্ত্রগুলো অবস্থিত—যারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি সরবরাহের বড় একটি অংশ পরিচালনা করে। এই অনিশ্চয়তা উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার এবং বাহরাইনের সরকারপ্রধানদের মুখপাত্ররা মন্তব্যের অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গে কোনো সাড়া দেননি। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা এ ধরনের কোনো সতর্কবার্তার বিষয়ে অবগত নয়, তবে এমন বার্তা অন্য কোনো চ্যানেলের মাধ্যমেও পাঠানো হয়ে থাকতে পারে।
বুধবার ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কুয়েত ইরানকে আশ্বস্ত করেছে যে তাদের ভূখণ্ড অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।
বৃহস্পতিবার ইরানের মিত্র রাশিয়া জানিয়েছে, ইসলামিক রিপাবলিকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার হুমকি গ্রহণযোগ্য নয়। পরদিন, শুক্রবার রাশিয়া সকল পক্ষকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানায়।
আরও এক ইরানি কর্মকর্তা বলেছেন, ইরান রাশিয়ার কাছ থেকে বেশি সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছে। তবে মস্কোর প্রকৃত প্রতিশ্রুতি নিয়ে তারা সন্দিহান। তার ভাষায়, এটি 'ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যকার সম্পর্কের গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভর করছে'।
দুই মাসের সময়সীমা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তিকে সামরিক সংঘাতের চেয়ে বেশি পছন্দ করেন। গত ৭ মার্চ তিনি জানান, আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে তিনি আয়াতুল্লাহ খামেনির কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন।
প্রথম ইরানি কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিকভাবে ওমানি মধ্যস্থতাকারীরা ইরানি ও মার্কিন প্রতিনিধিদলের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদান করবে। এভাবেই পরোক্ষ আলোচনা শুরু হতে পারে। খামেনি ইতোমধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি অথবা তার উপমন্ত্রী মাজিদ তাখত-ই রাভানচিকে মাসকাটে যেকোনো আলোচনায় অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছেন।
ওমান সরকারের একজন মুখপাত্র এ বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেননি।
তবে ওই কর্মকর্তা মনে করেন, একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে প্রায় দুই মাস সময় রয়েছে। কারণ, আলোচনায় বিলম্ব হলে ইরানের বহুদিনের শত্রু ইসরায়েল নিজে থেকেই হামলা চালাতে পারে—এমন আশঙ্কা রয়েছে। এতে করে ইরানের ওপর আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাগুলো হঠাৎ 'পুনর্বহালের' সম্ভাবনাও দেখা দিতে পারে, যা দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ঠেকানোর উদ্দেশ্যে নেওয়া হতে পারে।
ইরান দীর্ঘদিন ধরেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ইচ্ছার কথা অস্বীকার করে আসছে। তবে জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, দেশটি 'নাটকীয়ভাবে' ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা বাড়াচ্ছে—যার পরিমাণ এখন ৬০ শতাংশ পর্যন্ত, প্রায় ৯০ শতাংশ অস্ত্র-উপযোগী মাত্রার কাছাকাছি।
পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলোর ভাষ্য, কোনো বেসামরিক কর্মসূচির জন্য এত উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার প্রয়োজন নেই, এবং এর আগে কোনো দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করা ছাড়া নিজেদের এভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেনি।
ইরান বলেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ দূর করাই যদি আলোচনার উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংলাপ বিবেচনা করতে পারে। তবে হুমকি-ধমকির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করতে তারা রাজি নয়। সেই সঙ্গে তারা স্পষ্ট করেছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আলোচনার বাইরে থাকবে।
ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস কর্পসের (আইআরজিসি) কমান্ডার আমিরালি হাজিজাদে সোমবার ইঙ্গিত দেন, কোনো সংঘাতের ক্ষেত্রে অঞ্চলের যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হতে পারে।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বাগদাদে আইআরজিসি'র কুদস বাহিনীর প্রধান কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর ইরাকে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে পাল্টা হামলা চালিয়েছিল ইরান।