গৌতম আদানী কীভাবে ভারতের সবচেয়ে বড় নিউজ নেটওয়ার্ক পরিচালনা করবেন?

নিউ দিল্লী টেলিভিশন (এনডিটিভি)-এর প্রতিষ্ঠাতা যুগল রাধিকা এবং প্রন্নয় রায় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনাকারী গ্রুপের ডিরেক্টর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন গৌতম আদানী, বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি। খবর বিবিসির।
রাধিকা রায় তার স্বামী প্রন্নয় রায়ের সাথে এনডিটিভি প্রতিষ্ঠা করার ঘটনাকে একসময় 'ভালো দুর্ঘটনা' হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত দূরদর্শনের জন্য 'দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক' নামে একটি প্রোগ্রাম শুরু করেছিলেন দুজনে, কোনো বড় রকমের পরিকল্পনা নিয়েই। তাদের কোন ধারণাই ছিল না, বিশ্বসংবাদ নিয়ে একটি সাপ্তাহিক প্রোগ্রাম থেকে ভারতের প্রথম বেসরকারি ২৪ ঘণ্টার সংবাদ নেটওয়ার্কে পরিণত হবে এটি।
তিন দশকেরও বেশি সময় পর, এনডিটিভির মালিকানার হাতবদল হচ্ছে। এলন মাস্ক এবং জেফ বেজোসের পর বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানী এনডিটিভি কিনে নিচ্ছেন।
৬০ বছর বয়সী বিলিয়নেয়ার আদানী, যিনি বন্দর থেকে খণিজ সম্পদ এবং অন্যান্য এনার্জি সেক্টরের ব্যবসার সাথে জড়িত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর খুব কাছের লোক বলে পরিচিত। আদানীর জীবন নিয়ে সম্প্রতি লেখা বইয়ে আরএন ভাস্কর লেখেন, "আদানীর সবধরনের রাজনীতিবিদ এবং সামাজিক নেতার সাথে ভালো সম্পর্ক তাকে সব সরকারের আমলেই গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।"
গত মার্চ মাসে আদানীর নতুন কোম্পানি এএমজি মিডিয়া নেটওয়ার্কস লিমিটেড কুইন্টিলিয়ন নামের একটি ডিজিটাল সংবাদ কোম্পানি কিনে নেয়। ভাস্কর তার বইয়ে লেখেন, "আদানীর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কুইন্টিলিয়ন খুবই ছোট। তিনি কি বড় কিছুর পরিকল্পনা করছেন?"
এর আঁচ পাওয়া গেল কয়েক মাসের মধ্যেই। তবে ২৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক আদানীর কাছে ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেভিনিউ এবং ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লাভের এনডিটিভি খুব বেশি আকর্ষণীয় নয়। তবে এনডিটিভির আকর্ষণ অন্য কোথাও। ডেটার সাহায্যে ভোট বিশ্লেষণ, মর্নিং শো এবং টেলিভিশনে লাইফস্টাইল এবং প্রুযুক্তি বিষয়ক শোয়ের অন্যতম পথিকৃৎ এই এনডিটিভি। বর্তমানে অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মজুড়ে ৩৫ মিলিয়ন অনুসারী যুক্ত আছে এনডিটিভির সাথে।
আদানী গ্রুপের বক্তব্য অনুযায়ী, "এনডিটিভি তাদের লক্ষ্য পূরণের জণ্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্রডকাস্ট এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। আপনারা কেন একটি মিডিয়া হাউজকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে সমর্থন করতে পারবেন না, যেটি বৈশ্বিক পর্যায়ে কাজ করবে? ফাইন্যানশিয়াল টাইমস কিংবা আল জাজিরার সাথে তুলনা করার মতো একটিও গণমাধ্যম ভারতে এখনো নেই।"

অবশ্য এই অধিগ্রহণের বিপক্ষে সমালোচনাও কম নেই। অনেকেই এনডিটিভিকে মনে করেন ভারতের হাতেগোনা কিছু গণমাধ্যম যারা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, একইসাথে যারা অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোর মতো অতি-দেশপ্রেমিকে পরিণত হয়নি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং রয়টার্স ইন্সটিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ জার্নালিজমের এক গবেষণায় দেখা যায় ৭৬ শতাংশ উত্তরদাতা এনডিটিভির সংবাদকে বিশ্বাস করে এবং বস্তুনিষ্ঠ মনে করে।
আদানী গ্রুপের এই অধিগ্রহণের ফলে অনেকেই মনে করছেন সম্পাদকদের সততা ক্ষুণ্ণ হবে। গণমাধ্যমের বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও ভারতে স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ খুব বেশি নয়, অন্তত প্যারিসভিত্তিক রিপোর্টার্স উইদাইট বর্ডার্সের র্যাংকিং-এ ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের ১৫০তম অবস্থান তা-ই নির্দেশ করে। অবশ্য নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি দল এই ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পদ্ধতি 'সন্দেহজক এবং অস্বচ্ছ'।
গণমাধ্যমের বৈচিত্র্যতা অবশ্য গণমাধ্যমের মালিকানার একীভূত অবস্থা লুকিয়ে রেখেছে বলে মতামত অনেক বিশেষজ্ঞের। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স অনুযায়ী, হিন্দি ভাষার তিন-চতুর্থাংশ পাঠকই মাত্র চারটি দৈনিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভারতের আরেক বিলিয়নেয়ার মুকেশ আম্বানিও নেটওয়ার্ক১৮ নামের ভারতের অন্যতম বড় গণমাধ্যম নেটওয়ার্কের মালিক। প্রতিবছর আদানী এবং আম্বানির রেভিনিউ ভারতের জিডিপির ৪ শতাংশের সমান।

এনডিটিভির এই মালিকানা পরিবর্তন অবশ্য ভারতের সংবাদ ব্যবসার ফাঁকফোকরও প্রদর্শন করছে। ভানিতা কোহলি-খান্দেকার, একজন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ জানান যে, ভারতের ৪০০টি সংবাদমাধ্যমের বেশিরভাগই আঞ্চলিক ভাষার এবং বেসরকারি। পুরো টেলিভিশন জগতের বিজ্ঞাপন থেকে ৪২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের মাত্র ৮ শতাংশ সংবাদ বিষয়ক চ্যানেলগুলো পেয়ে থাকে।
যেহেতু সংবাদের জন্য মানুষ খুব বেশি খরচ করতে চায় না, তা-ই চ্যানেলগুলোর বেশিরভাগ আয়ই আসে বিজ্ঞাপন থেকে। ফলে সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক কমে গেছে বলে মনে করেন অনেকে। অনেক সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে 'নোংরা ট্যাবলয়েডাইজেশন' এবং পক্ষপাতমূলক সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ রয়েছে।
এনডিটিভির নিজেদের অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয় এক দশক আগে যখন তারা আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রির একটি কোম্পানি থেকে ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিতে বাধ্য হয়। কোহলি-খান্দেকার জানান, "এনডিটিভি বহুদিন ধরেই টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করে আসছে, তবে এবার মনে হচ্ছে তারা হেরে যাচ্ছে। গণমাধ্যম ব্যবসার জন্য এটি একটি পরাজয়।"

নতুন মালিকের অধীনে সম্পাদকীয় আধেয়ে পরিবর্তন আসবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে। "ভারতে যখন টেলিভিশন সংবাদ একেবারেই গোঁড়াপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে, সে সময় এনডিটিভি-ই সরকারের সমালোচনা করার সাহস দেখিয়েছিল, যখন অন্যরা সেটি করতে এগিয়ে আসেনি। এখন কি তারা সম্পাদকীয় বাধার জন্য সেখান থেকে আরও নিরপেক্ষ অবস্থানে সরে আসবে?" জানান অরম্যাক্স মিডিয়ার শৈলেশ কাপুর।
আদানী মনে করেন এ ব্যাপারে ভয়ের কোন কারণ নেই। আদানী ফাইন্যানশিয়াল টাইমসকে জানান, "স্বাধীনতা মানে যখন সরকার কোনো ভুল করবে তখন তার সমালোচনা করা। কিন্তু একইসাথে সরকার ভালো কোনো কাজ করলে আপনাকে সেটিও প্রকাশ করার সাহস থাকতে হবে।"