জুরাইন কবরস্থান: মৃতদের জন্য বিশ্রামাগার, জীবিতদের জন্য প্রশান্তির জায়গা
পুনর্নির্মিত জুরাইন কবরস্থানের সাথে শনির আখড়া ও জুরাইনে বেড়ে ওঠা মানুষদের অনেক আবেগ ও স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
সন্ধ্যায় আমাদের টিচারের কাছে পড়তে যতে হতো। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সন্ধ্যার ক্লাস বাদ দিতাম। কারণ সন্ধ্যার পর কবরস্থানের দেয়াল ঘেঁষে বাসায় ফিরতে আমরা ভয় পেতাম। এই দেয়ালগুলো এক সময় খুন হওয়া লাশ ফেলে যাওয়ার জন্য কুখ্যাত স্থান ছিল। স্থানীয়রা বলত, অপরাধীরা রাতে দেয়ালের উপর দিয়ে লাশ ফেলে দিয়ে যেত।
আজ সেই জায়গাটির চেহারাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটি এখন চিন্তন-মননের, উন্মুক্ততা ও স্থানীয়দের জন্য শান্ত পরিবেশে সময় কাটানোর এক স্থানে পরিণত হয়েছে। এ রূপান্তর সম্ভব হয়েছে একদল স্থপতির কারণে। তারা এ ক্ষয়িষ্ণু জায়গায় সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছিলেন।
মৃত্যু ও নকশাকে নতুন করে ভাবার আহ্বান
২০১৭ সালে নিউ মার্কেট থেকে ধানমন্ডি ২৭ পর্যন্ত রাস্তাটিকে হাঁটার উপযোগী করার জন্য এক প্রতিযোগিতায় জয়ী হন দেহসার ওয়ার্কসের প্রধান স্থপতি রাশেদ চৌধুরী। সেটির কাজ করতে গিয়েই কবরস্থানটি পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব পান।
রাশেদ চৌধুরী বলেন, 'সিটি কর্পোরেশন আমাদের জিজ্ঞেস করে যে আমরা কবরস্থানের প্রধান ফটকের নকশা ও একে পুনর্নির্মাণের কাজ করতে পারবো কিনা।'
সিটি কর্পোরেশনের প্রস্তাবে রাশেদ ও তার দল জুরাইন কবরস্থানটি পরিদর্শনে যান। সেখানে গিয়ে তারা কবরস্থানটির ভগ্নদশা দেখতে পান। রাশেদ বলেন, সেসময় সিটি কর্পোরেশন তাদের কাছে তিনটি দাবি জানান। প্রথমটি ছিল, কবরস্থানটির সীমানাপ্রাচীর স্বচ্ছ হতে হবে। দ্বিতীয়ত, সীমানাপ্রাচীর এতো উচু হতে হবে যাতে যে কেউ এটি টপকাতে না পারে কিংবা ভারী কোনো বস্তু —যেমন লাশ ফেলে যেতে না পারে। তৃতীয়ত, প্রাচীরে কোনো লোহার কলাম বা বিম থাকতে পারবে না।"
রাশেদ জানান, সিটি কর্পোরেশনের এ চাহিদার পেছনের কারণগুলোও ছিল ভীতিকর। তিনি বলেন, 'অপরাধীরা রাতে প্রায়ই সীমানা প্রাচীরের উপর দিয়ে লাশ ফেলে দিত যাতে কেউ তাদের দেখতে না পারে। এমনকি, পলিথিন ব্যাগে মোড়ানো অবস্থায় গর্ভপাত করে ফেলা নবজাতক শিশুদেরও কবরস্থানে ফেলা হতো। তাছাড়া স্থানীয় অপরাধীরা লোহার জিনিসপত্র চুরি করে বিক্রি করে দিতো। যার কারণে লোহা ব্যবহার করা যেত না।'
কবরস্থানের মাস্টারপ্ল্যান
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক অনুমোদিত জুরাইন কবরস্থানটির আয়তন ৬৭ হাজার ৯৮৭ দশমিক ১৯ বর্গমিটার। কবরস্থানটির সংস্কার কাজ ২০১৭ সালে শুরু হয়ে ২০২৪ সালে শেষ হয়।
প্রাথমিকভাবে, স্থপতিদের শুধু প্রধান ফটকটি পুনর্নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা যখন প্রায় ১৬ একরের সবুজে ঘেরা স্থানটি দেখতে পান, তারা এর মধ্যে ব্যাপক সম্ভাবনা খুঁজে পান।
রাশেদ বলেন, "আমরা বুঝতে পারি জায়গাটির সীমানাপ্রাচীর যদি স্বচ্ছা করা যায় তাহলে এর সঙ্গে স্থানীয়দেরও একটি সংযোগ তৈরি হবে। এলাকায় কোনো খেলার মাঠ বা পার্ক নেই। তাই, আমরা কবরস্থানটির জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ মাস্টার প্ল্যান তৈরি করি এবং এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকল্পে পরিণত হয়।"
স্থপতিরা জানতেন, দীর্ঘমেয়াদি সরকারি প্রকল্পে নির্মাণকাজের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ খুবই সীমিত থাকবে। তাই তাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি নকশা তৈরি করা, যা কর্তৃপক্ষ বা বাস্তবায়নের পরিবর্তন সত্ত্বেও টিকে থাকবে এবং স্থানীয়দের প্রয়োজনও পূরণ করবে।
তাই তারা বিলাসবহুল বা আমদানি করা উপকরণের ব্যবহার এড়িয়ে গেছেন। পরিবর্তে, তারা এমন একটি জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করলেন যা পরিচিত, সর্বজনীন এবং মেরামতযোগ্য মনে হয়।
রাশেদ বলেন, 'আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যা পরিচিত এবং সার্বজনীন। এমন কিছু, যা বিপরীতমুখী না, এলাকার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে খাপ খায় এমন।'
নকশার ভাষা
তবে প্রেক্ষাপটের কারণে দলটির জন্য কাজটি করা চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ তাদের একই সঙ্গে মানবিক দিক বিবেচনা করতে ও একে পুনরুদ্ধারের কাজও করতে হবে।
প্রধান নির্মাণসামগ্রী হিসাবে কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে। রাশেদ বলেন, "ধূসর রঙের কংক্রিট স্বাভাবিকভাবেই একঘেয়ে এবং মানুষের মনে বিষণ্নতার ছাপ ফেলে। কবরস্থান এমনিতেই শোকের স্থান, তাই আমরা লাল কংক্রিট দিয়ে নকশার মাধ্যমে জায়গাটিকে একটু জীবন্ত করতে চেয়েছি।"
জায়গাটিতে একটু উষ্ণ ভাব বজায় রাখতে ও সময়ের সাথে সাথে একে আকর্ষণীয় রাখতে কংক্রিটের মিশ্রণে গাঢ় লাল রঙ ব্যবহার করা হয়। লক্ষ্য ছিল কাঠামোটি যেন সময়ে সাথে সাথে নির্জীব বা জরাজীর্ণ না দেখায়। একে কেবল নান্দনিক নয় মনস্তাত্ত্বিক কারণেও রঙ করা হয়েছিল। শোকের পরিবেশে, লাল দেয়ালগুলো জীবন এবং পুনরুজ্জীবনের একটি ইঙ্গিত দেয়।
দেয়ালের লম্বালম্বি পিলারগুলো নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি প্রতীকী ভূমিকাও রাখে। এগুলো একপ্রকার ছন্দ তৈরি করেছে। পাশাপাশি বাতাস চলাচলও স্বাভাবিক রাখে। তাছাড়া অভ্যন্তরে কবরের নাম ফলকগুলোর লম্বা আকৃতির সঙ্গেও মিলে যায়। এতে কৃত্রিমভাবে বানানো ও প্রকৃতির স্মৃতিচিহ্নের পার্থক্য একে অপরের সঙ্গে লীন গেছে।
সংরক্ষণের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই এই মুসলিম সমাধিস্থলটির উন্নয়ন করা হয়। স্থাপত্য দলটি বিদ্যমান কাঠামো বজায় রেখেছিল। নতুন নকশা পরিকল্পনা অনুযায়ী মূল ছাউনিগুলো সংস্কার করা হয়। আর কাচগুলো এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল যাতে এর ভেতর দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বাতাস চলাচল করতে পারে, আবদ্ধ মনে না হয়।
রাশেদ বলেন, "সবকিছু যেমন ছিল তেমনই রাখা হয়েছে। কাচ সাবধানে ব্যবহার করা হয়েছে যাতে সেগুলো বাতাস আটকে না দেয়। আর বিদ্যমান ছাউনিগুলোও রাখা হয়েছিল। কেবল পরিকল্পনা অনুযায়ী সংস্কার করা হয়েছিল। তবে জায়গাটিতে নারীদের জন্য নিরাপদ প্রার্থনার স্থান তৈরি করতে কিছু পরিবর্তন করা হয়।"
গোলাকার প্রার্থনা হলটিও একইভাবে লম্বালম্বি পিলারের মতো নকশা করা হয়েছে। তবে মূল নকশায় সেখানে একটি বাগান ছিল, যাতে মানুষ বাগানে বসে তাদের প্রিয় মৃতজনের জন্য প্রার্থনা করতে পারে।
সহজ-সরল পরিকল্পনাই একে দৃঢ় করেছে
প্রকল্পটির একটি আকর্ষণীয় ফলাফল হলো, স্থানীয়দের আচরণে পরিবর্তন। রাশেদ বলেন, "সীমানাপ্রাচীরের সঙ্গে স্থানীয়দের সংযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের নকশায় এটি ছিল একেবারেই অনুপস্থিত।"
প্রকল্পের সাফল্য এসেছে নান্দনিকতা, স্থায়িত্ব এবং সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতার মধ্যে সুষম বণ্টন বজায় রাখার মাধ্যমে। স্থপতিরা চেয়েছিলেন, নির্মাণ কাজ নিখুঁত না হোক কিন্তু এটি যেন নমনীয় হয় এবং স্থানীয়দের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।
রাশেদ বলেন, 'সমাধানটি এমন হতে হবে যা দীর্ঘস্থায়ী হবে, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যাওয়ার পরও এর নান্দনিকতা বজায় থাকবে। এটি স্থিতিশীল এবং মেরামতযোগ্য শাটার পুন:ব্যবহারের মাধ্যমে এর নান্দনিকতাও বজায় থাকবে।'
এটি সংস্কার করার সময় প্রাকৃতিক আলো এবং বায়ুচলাচলকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল বলে জানান রাশেদ। তিনি বলেন, 'এটি ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও, নকশাটি সুন্দরভাবে পুরোনো হবে।"
জীবিতদের কথা মাথায় রেখেই নকশা করা
শুধু শোকের স্থান হিসেবে জায়গাটি আলাদা করার বদলে, স্থপতিরা এটিকে একটি জীবন্ত ল্যান্ডস্কেপ হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। রাশেদ বলেন, 'জায়গাটি যেন স্থানীয়দের মেলামেশা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্মুক্ত করার সুযোগ করে দেয়।'
স্থানটির মর্যাদা ও পবিত্রতা বজায় রেখেই কবরস্থানটি একটি 'শ্রদ্ধাপূর্ণ বিশ্রামাগার' ও একই সঙ্গে জীবিতদের জন্য একটি শান্ত ও সার্বজনীন মিলনস্থল হিসেবে এর নকশা সাজানো হয়েছে।
এটি স্থানীয়দের কল্যাণে দৃঢ় প্রতিশ্রুতির প্রতিফলনের মাধ্যমে স্মৃতিকে ধরে রাখা ও একই সঙ্গে স্থানীয়দের দৈনন্দিন জীবন উভয়কেই সমানভাবে সম্মান করে।
সর্বসাধারণের জন্য নির্মিত স্থাপত্য প্রকল্প প্রায়শই রাজনৈতিক প্রশাসন, দল, এমনকি তাদের মূল ম্যান্ডেটের চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী হয়। জুরাইন কবরস্থান প্রকল্পটি একটি ধারাবাহিকতার শিক্ষা— এটি দেখায় কিভাবে স্থাপত্য সময়, রাজনীতি এবং আবেগের সাথে মানিয়ে নিতে পারে।
কার্যকারিতা ও সহমর্মিতা একত্রিত করে স্থপতিরা একটি কবরস্থান কীভাবে তার শহরের সেবা করতে পারে তা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এটি কেবল মৃতদের জন্য একটি বিশ্রামস্থল নয় বরং জীবিতদের জন্যও প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার একটি স্থান হতে পারে।
