ছবির ফ্রেমে বাঁচা: মুঠোফোনের যুগে ক্যামেরা যখন জীবিকার হাতিয়ার!

কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরাটি নামিয়ে ঠিকঠাক সেট করে নিলেন স্বপ্নীল (ছদ্মনাম)। এরপর শুরু হলো ছবি তোলা। বিকেল গড়ালেও চোখে-মুখে ক্লান্তি নেই, নেই বিরক্তির রেশটুকুও। শুক্রবার হওয়ায় মানুষের ভিড়ও বেশি। তাই কাজের চাপও বাড়তি। একজনের ছবি তোলা শেষ হলেই অন্যজন এসে দাঁড়িয়ে পড়ছেন ক্যামেরার সামনে। পাশেই কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছেন ছবি তোলার অপেক্ষায়। কেউ এসেছেন পরিবার নিয়ে, কেউবা ভালোবাসার মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে, আবার কেউ এসেছেন একা। তাদের কারো মুখে ঘাম, কারো চোখে বিরক্তির ছাপ—তবু সবাই দাঁড়িয়ে আছেন কিছু স্মৃতি ও ভালো মুহূর্তগুলো ফ্রেমবন্দি করবেন বলে।
স্বপ্নীল জানেন মুহূর্ত ধরে রাখার মূল্য কতখানি। তাই বেশ যত্ন করেই ছবি তোলেন তিনি। মুখে হাসি নিয়ে স্বপ্নীল বললেন, 'সবাই তো আর ফোনে ছবি তুলতে পারে না, কিন্তু সবাই চায় একটা ভালো ছবি থাকুক।'
প্রতি ছবির দাম মাত্র ১০ টাকা। কোনো উৎসব বা বিশেষ দিনে সেটা বেড়ে হয় ২০ টাকা। স্বপ্নীল দিনে কমবেশি ৫০-১০০ জনের ছবি তোলেন। শর্ত একটাই—ছবি তুলতে হবে অন্তত ১০টি, নয়তো সময়ের মূল্যটা ঠিক ওঠে না।
বিকেলের শেষ আলোয় যখন ভিড় কমে এল, তখনও দেখা গেল স্বপ্নীল এক বৃদ্ধ দম্পতির হাসিমুখ ক্যামেরাবন্দি করছেন। একসময় পেটের দায়ে পেশা হিসেবে এ কাজ বেছে নিয়েছিলেন স্বপ্নীল, এখন সেটাই তার কাছে নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছোটবেলায় এক মামার কাছে ছবি তোলার হাতেখড়ি স্বপ্নীলের। তখন থেকেই মনে হতো, যদি নিজের একটা ক্যামেরা থাকত! খুব বেশি দূর লেখাপড়া করেননি স্বপ্নীল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করতেন তিনি। তখন মাথায় আসে ফটোগ্রাফির কথা। শুরুতে মামার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা শুরু করেছিলেন। প্রতিদিন যা আয় হতো, তার অর্ধেক মামাকে দিতেন। আর নিজের আয় থেকে অল্প অল্প করে সঞ্চয় শুরু করলেন। বছর দুয়েক পর একটা ক্যামেরা কিনলেন। শুরুর দিকে বিভিন্ন ইভেন্টে বিনামূল্যেও ছবি তুলেছেন তিনি।
করোনার সময়ে ফটোগ্রাফির একটা ফেসবুক পেজ খোলেন স্বপ্নীল। তখন থেকে ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করেন তিনি। যেহেতু শুরুটা হয়েছিল ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফি দিয়েই, তাই এ ব্যাপারটার প্রতি তার আজও অন্যরকম একটা ভালোবাসা রয়ে গেছে।
স্বপ্নীলের ফেসবুক পেজ এখন বেশ পরিচিত। প্রতিদিনই হাতে কোনো না কোনো কাজ থাকেই তার। শুধু তো ছবি তোলা নয়, এডিটিংয়ের কাজও করতে হয়। স্ত্রীকে এডিটিংয়ের কাজ শিখিয়েছেন। এখন এডিটিংয়ের জন্য আলাদা করে আর তার লোকের দরকার নেই। ফটোগ্রাফির টাকা দিয়েই কিনেছেন পাঁচটি ক্যামেরা। তার অধীনে এখন কাজ করেন পাঁচজন ফটোগ্রাফার।
অনেক ফটোগ্রাফার যাদের ক্যামেরা কেনার সামর্থ্য নেই, তারা স্বপ্নীলের মতো ব্যক্তিদের কাছ থেকে ঘণ্টা হিসাবে ক্যামেরা ভাড়া নেন। এতে রোজকার যে আয়, সেটার অর্ধেক ক্যামেরার মালিককে দিতে হয়। বাকি অর্ধেক ফটোগ্রাফারের নিজের। এসব ফটোগ্রাফারের অনেকেই আগে ফুল বিক্রি করতেন। সেটা ছেড়ে এখন তারা এ কাজে নেমেছেন।
এর কারণও যুতসই। পার্কগুলোতে মানুষ ঘুরতে এলেই ছবি তোলেন। প্রতিদিন শত শত মানুষের আনাগোনা থাকে উদ্যানগুলোয়। ঘুরতে গিয়ে ফোনের চেয়ে নিজেকে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করাটা পছন্দ করেন অনেকেই। এ কারণে ক্যামেরায় ছবি তোলার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে বললেও ভুল হবে না। ফলে ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফারের সংখ্যাও বাড়ছে।
রাজধানীর রমনা পার্কে প্রায় ৫০ জন ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফার প্রতিদিন ছবি তোলেন। তাদের সবাই যে প্রশিক্ষিত, তেমনটা কিন্তু নয়। কেউ কেউ শিখে আসেন সেটা যেমন সত্যি, আবার কেউ কেউ ছবি তুলতে তুলতে শেখেন, এটাও এই সত্যের আরেক পিঠ। বেশিরভাগ তরুণই অভাবের তাড়নায়, বেকারত্বের চাপে এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন- এমনটাই বলছিলেন স্বপ্নীল।
রমনা পার্কে এক পড়ন্ত বিকেলে গিয়েছিলাম এমন ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফারের সন্ধানে। সেখানে এমন একজনের সঙ্গে দেখা হলো যিনি ইভেন্ট ফটোগ্রাফি করেন। তার নাম রাকিব হাসান। ইভেন্ট থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আসে বটে, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ইভেন্টগুলো পড়ে রাতে। দিনের বেলা বসে থাকতে হয়। তাই বসে না থেকে এই সময়টাতে ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফির কাজ করেন রাকিব।
এ কাজে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যেদিন ইচ্ছে হলো এলেন, ইচ্ছে হলো না, এলেন না। তবু বসে অলস সময় কাটানোর থেকে কিছু আয় হওয়াটা স্বস্তির।
রাকিবের ছবি তোলার হাত বেশ পাকা, পাশাপাশি বেশ আলাপীও বটে। নিজে থেকেই বলে চলছিলেন তার জীবনের গল্প। বছর সাতেক আগে যখন ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন, তখন চিন্তাও করতে পারেননি, ফটোগ্রাফি করে স্বচ্ছলভাবে সংসার চালাতে পারবেন। তবু নেশাটাকে পেশা করেছিলেন ভালোবাসার টানে।
আবেদন কমেনি এতটুকুও!
আজকের দিনে ছবি তোলা যেখানে খুব সোজাসাপ্টা বিষয়, সেখানে ক্যামেরা কিংবা প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারদের জায়গাটা কি রয়ে গেছে? উত্তর হলো- হ্যাঁ, এখনো ক্যামেরার প্রতি মানুষের আবেদন এতটুকুও কমেনি। সেটা বোঝা যায় বিয়ে, গায়ে হলুদের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো দেখলে। এসব অনুষ্ঠানে ছবি তোলার ক্ষেত্রে ফোনের ক্যামেরা যত ভালোই হোক না কেন, ডাক পড়ে পেশাদার আলোকচিত্রীর। যদিও ছবির পোজ, এডিটিং থেকে শুরু করে ছবি হাতে পাওয়ার সময়ে কয়েক দশকে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। ওয়েডিং ফটোগ্রাফির পাশাপাশি প্রি-ওয়েডিং, পোস্ট-ওয়েডিং ফটোগ্রাফিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
তবে এসবের বাইরেও ক্যামেরার যে চাহিদা নেই তা কিন্তু নয়। ক্যামেরায় ছবি তোলার সেই শখ মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে আজও। ঢাকা শহরের রমনা পার্ক, জিয়া উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো জায়গাগুলোতে বিকেল হলেই মানুষের ভিড় বাড়ে। কেউ বা প্রকৃতির সান্নিধ্য খোঁজার তাগিদে, কেউ বা দুই দণ্ড স্বস্তির আশায় এসব জায়গায় যান। আর এ জায়গাগুলোতেই দেখা মেলে ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফারদের। নামমাত্র মূল্যে ডিএসএলআর ক্যামেরার দিয়ে ছবি তুলে দেন তারা। ছবি তোলার পর মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ওটিজি ক্যাবলের মাধ্যমে সেগুলো পাঠিয়ে দেন গ্রাহকের ফোনে।
বিলাসিতা থেকে ডালভাত
যুগ পাল্টায়, কিন্তু ক্যামেরায় ছবি তোলার চল ঠিকই রয়ে যায়। ক্যামেরার যেমন নিত্য নতুন মডেল বের হচ্ছে, তেমনি স্টুডিওর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে, বাড়ছে ফটোগ্রাফারদের সংখ্যাও।
ষাটের দশকেও রোদ না উঠলে ভালো ছবি তোলা যেত না। মেঘলা আবহাওয়া, সন্ধ্যা বা বিকেলে ছবি তোলা ছিল প্রায় অসম্ভব। এরপর নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যুক্ত হলো হলদেটে ফ্ল্যাশ বাল্ব। সাদা-কালো ছবি রঙিন হতে শুরু করল একবিংশ শতাব্দীতে এসে। ধীরে ধীরে ক্যামেরার আকারেও দেখা গেল পরিবর্তনের ছোঁয়া।
ফটোগ্রাফির প্রথম দিকে প্রচলন ছিল টিএলআর, টুইন লেন্স রিফ্লেক্স ক্যামেরার। এখানে মূলত দুটি লেন্স ব্যবহার করা হতো। একটি ভিউ ফাইন্ডারের জন্য, অন্যটি ছবি তোলার জন্যে। কিন্তু লেন্স দুখানা লম্বভাবে থাকার দরুন ভিউ ফাইন্ডারে যা দেখা যেত, হুবুহু সেই ছবি উঠত না। পরবর্তীকালে এসএলআর অর্থাৎ সিংগেল লেন্স রিফ্লেক্স ক্যামেরা আসার পর ফটোগ্রাফিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। এটাতে একটি লেন্স দিয়েই দুটা কাজ করা সম্ভব হলো, মিরর ব্যবহারের কারণে।
ইয়াসিকা, ক্যানন, সনি, নিকনের মতো ব্রান্ডগুলো আস্তে আস্তে প্রবেশ করতে শুরু করে এসএলআরের জগতে। ডিজিটাল এসএলআর ক্যামেরা আসার পর ছবি তোলা আরও সহজ হতে লাগলো। এটাতে কোনো ফিল্ম বা নেগেটিভ কপির দরকার পড়ে না। চাইলেই ডিজিটাল কপি মেমোরি কার্ডে সংরক্ষণ করা যায়।
এরপর এল মোবাইল ফোন। প্রথম দিকের ফোনগুলোতে যে ক্যামেরা যুক্ত করা হতো, তা আসলে ক্যামেরার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো শক্তিশালী ছিল না। তবে নকিয়া সিরিজের ফোনগুলোতে ক্যামেরা ফিচার এর জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকটাই। ধীরে ধীরে স্মার্টফোনের প্রচলন এবং এতে যুক্ত থাকা ক্যামেরা মানুষকে ছবি তোলার ব্যাপারটিতে অনেকটা অভ্যস্ত করে তুলতে শুরু করে। চাইলেই যে কেউ যে কারো ছবি তুলতে পারছে- এ ব্যাপারটিই বেশ চমকপ্রদ। ফটোগ্রাফি জিনিসটা বিলাসিতা থেকে ডাল-ভাতে নেমে আসে মূলত এ সময় থেকেই। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছবি শেয়ার করার মতো বিষয়গুলো হয়ে ওঠে সাধারণ একটা বিষয়।
পরিচয় প্রকাশে অনাগ্রহ, কিন্তু কেন?
বিকেলের কনে দেখা আলো। জারুল গাছের নিচে ঝরে পড়ে আছে ফুল। নাম না জানা আরও কত ফুলের গন্ধে ম ম করছে চারদিক। বইছে সুবাতাস। পাখির কিচিরমিচির জায়গাটাকে করে তুলেছে আরও স্বপ্নময়। মনে হয়, আরও দুদণ্ড বসি, আরও দু-চারটে কথা বলি। হ্যাঁ, জিয়া উদ্যানের কথা-ই বলছি। জিয়া উদ্যানের এই সুন্দর পরিবেশে কার না মনে চায় সময়টা ফ্রেমবন্দি করতে? বসন্তের পর বসন্ত পেরিয়ে যাবে, তবু বহু বছর পর ছবিখানা দেখলেই মনে পড়বে ফুলের সেই মিষ্টি গন্ধ। কী জীবন্ত! যতবার ছবিগুলোতে চোখ পড়বে, ততবারই মনে হবে সেই মুহূর্তগুলোর কথা। আর এ মুহূর্তগুলো ধরে দিতে তাই সেখানে হাজির ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফারের দল।
তাদেরই একজন তানভীর। তার ক্যামেরায় বেশ কিছু ছবি তুললাম। সত্যিই দারুণ ছবি তোলেন তিনি। অনেকদিন ধরে বাড়ি বসে ছিলেন তানভীর। কোনো চাকরি বাকরি পাচ্ছিলেন না। ক্যামেরা কিনেছিলেন অনেক আগে, শখের বশে। তখনও ভাবেননি এই ক্যামেরা, কয়েকটা ক্লিক একসময় পেটের ভাত যোগাবে। দিনপ্রতি প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা আয় রোজগার হয় তার। বিশেষ দিনগুলোতে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকাও হয়। আরও কয়েকজন ফটোগ্রাফারও প্রায় একই কথা শোনালেন।
তবে এই ফটোগ্রাফারেরা কিছুতেই নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। ভোগেন এক ধরনের হীনম্মন্যতায়। কেউ কেউ পরিবারের কাছ থেকে লুকিয়ে ফটোগ্রাফির কাজ করেন। কেননা এখনো ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফারদের মানুষ ফটোগ্রাফার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না। ভালোবাসার বা পছন্দের এ কাজটি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য শুনতে শুনতেই এমন লুকোচুরি শুরু হয়েছে। অথচ ফটোগ্রাফির কাজখানা কিন্তু একেবারেই এলেবেলে কাজ নয়। এ দক্ষতা সবার নেইও।
ভ্রাম্যমাণ এই ফটোগ্রাফারদের সবারই মোটামুটি তিন থেকে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে এ কাজের। কেউ কেউ শখের বশে এসেছেন এ পেশায়, কেউ আবার অভাব থেকে। সংসারের ভার টানতেই আপন করেছেন ছবি তোলার কাজটিকে।
শিক্ষার্থীরাও করছেন পার্ট টাইম কাজ হিসেবে
ক্যামেরা ফটোগ্রাফির এ কাজ শুধু যে পেশাদাররাই করছেন তা নয়। অনেক শিক্ষার্থীও এটাকে পার্ট টাইম কাজ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন সাগ্রহে। এমন একজন আজিজুল আহমেদ।
ক্লাস ফাইভের এক সরল বয়সে আজিজুলের হাতে প্রথম উঠেছিল ক্যামেরা। তার এক আংকেলের ডিএসএলআর ক্যামেরায় ফটোগ্রাফির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে ক্যামেরার কাজ শিখতেন। তখনও হয়তো বুঝতেন না, এই আগ্রহ একদিন দাঁড় করাবে সফলতার এক অনন্য উচ্চতায়।
সুনামগঞ্জের ছেলে আজিজুল। ২০১৫ সাল থেকে একটু একটু করে এ কাজের ভেতরে মিশে যেতে থাকেন। বয়স তখন ১১ বা ১২ বছর হবে। পর্যটন শহর সুনামগঞ্জে প্রতিদিনই নানা জায়গা থেকে মানুষ আসত। ক্যামেরায় মানুষের ছবি তুলতে চাওয়ার চাহিদা বুঝে টুকটাক ছবি তুলে দেওয়ার কাজ করতেন। সে সময়ে বাসা থেকে পকেট মানি না পাওয়ায় নিজের খরচ চালাতে ফটোগ্রাফি করা শুরু করেন।
এরপরে স্থির করলেন ফটোগ্রাফি করে ভালো কিছু করতে হবে। সেই চিন্তা থেকে ২০২১ সালে মাত্র ১৬-১৭ বছর বয়সে আজিজুল ঢাকায় পা রাখেন। হাতে ছিল না নিজস্ব ক্যামেরা। আইফোন ফাইভএস বিক্রি করে পাওয়া ১৫ হাজার টাকা, মায়ের আর বোনের দেওয়া সহায়তায় তিনি প্রথম ক্যামেরা কেনেন। ৪০ হাজার টাকায় কেনা সেই ক্যামেরা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে থাকেন। পড়াশোনার পাশাপাশি টুকটাক কাজ করে টাকা জমিয়ে আজিজুল এখন গড়ে তুলেছেন প্রায় ১০ লাখ টাকার ক্যামেরা সেটআপ।
তবে ঢাকায় এসে শুরুটা ছিল কঠিন। পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনের তেমন কোনো সাপোর্ট ছিল না। ফ্রিল্যান্সিং দিয়ে শুরু করেন নিজের পেশাগত যাত্রা। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। বর্তমানে ফিল্ম অ্যান্ড থিয়েটার বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তিনি। পড়াশোনার যাবতীয় খরচের পাশাপাশি পরিবারের দায়িত্বও তুলে নিয়েছেন কাঁধে। আর এ সবটাই তিনি করতে পেরেছেন ছবি তোলার কাজ করে। তাই এই পেশার প্রতি অন্যরকম ভালোলাগাও তৈরি হয়েছে তার। এমনকি ভবিষ্যতে পেশা হিসেবে এ কাজকেই বেছে নেবেন বলেই ফিল্ম অ্যান্ড থিয়েটার বিভাগে ভর্তি হয়েছেন।
বর্তমানে আজিজুলের নিজস্ব স্টুডিও রয়েছে। সেখানে তিনি ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি এবং ফটো এডিটের কাজ করেন। তিনি মূলত প্যাকেজ আকারে ছবি তোলেন। দুই-তিন ঘণ্টার প্যাকেজের জন্য আয় হয় তিন-চার হাজার টাকা। মাস শেষে যা দাঁড়ায় লাখ টাকায়।
এছাড়াও আকিজ গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও কাজের অভিজ্ঞতা আছে তার। 'আজিজ ফটোগ্রাফি' নামে ফেসবুকে একটি গ্রুপও রয়েছে, যেখানে তিনি নিয়মিত কাজের আপডেট দেন।
আজিজুলের ভাষ্যে, 'এ সেক্টরে কাজ জানলে টাকা আছে অনেক। আমার মনে হয় যেসব শিক্ষার্থী বেকারত্ব নিয়ে চিন্তায় থাকেন, তাদের জন্য ফটোগ্রাফি একটা ভালো ইনকাম সোর্স হতে পারে। একটু ধৈর্য নিয়ে কাজ করলে কেউ হতাশ হবে না।'
তবে স্ট্রিট ও আউটডোর ফটোগ্রাফি যারা করেন, তারা ইনডোর ফটোগ্রাফারদের চেয়ে তিন গুণ বেশি আয় করেন বলে জানান আজিজুল।
পিছিয়ে নেই নারীরাও
এখন শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও আছে এ পেশায়। অনেকেই শখের বশে কেনা ক্যামেরাকে নিজেদের জীবিকা বানাচ্ছেন। নারী ফটোগ্রাফারদের কাছে ছবি তুলতে অনেকেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। প্রযুক্তির আধুনিকায়নের এই যুগে ছবি নিরাপত্তা জরুরি ইস্যু- এটাও একখানা কারণ। অবশ্য আরও আগে থেকেই এই চল চালু ছিল।
সময়টা বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন সবে শেষ হয়েছে। সে সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে নারীরা অনেকটা গৃহবন্দী। রক্ষণশীল সমাজের নিয়মে তারা বাড়ির বাইরে একা বের হতে পারতেন না। ঠিক এরকম প্রেক্ষাপটে অন্নপূর্ণা দত্ত নামের এক সাহসী বাঙালি নারী ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে বিষয়টা রূপকথার গল্প মনে হলেও ঘটনা সত্যি।

নিজে পর্দার আড়াল ছেড়ে বের হলেও তখন বেশিরভাগ বাঙালি নারীই ছিলেন পর্দার আড়ালে। এদের ছবি তোলাকে পেশা হিসেবে নিলেন তিনি। সূর্যের আলো দেখেননি এমন বাঙালি নারী, যার জীবন যায় রান্নাঘরের উনুনের আঁচে – সেসব অন্তপুরবাসিনীর ছবি তুলতেন অন্নপূর্ণা দেবী। এসব ছবি তোলা হতো প্রয়োজনের খাতিরে কিংবা স্মৃতি রক্ষার্থে। তবু বাড়ির মা-বউয়ের ছবি পরপুরুষের হাতে পড়তে দেওয়া চলে না। তাই এসব ছবি ওয়াশ করে তিনি নিজেই গিয়ে পৌঁছে দিতেন ছবিগুলো।
শুধু যে অন্নপূর্ণা এ কাজ করতেন তা কিন্তু নয়। ১৮৯৯ সালে কলকাতার অমৃতবাজার পত্রিকায় 'মহিলা আর্ট স্টুডিও অ্যান্ড ফটোগ্রাফিক স্টোর'-এর বিজ্ঞাপন খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে লেখা 'সম্পূর্ণ আড়ালে ও সম্মানজনক ব্যবস্থায় শ্রীমতি সরোজিনী ঘোষের তত্ত্বাবধানে মহিলাদের ছবি তোলার ব্যবস্থা রয়েছে।'
এছাড়া ঠাকুর পরিবারের গিন্নি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড স্টুডিওতে গিয়ে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। যদিও তিনি ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে বেছে নেননি।
তবে আধুনিক নারীরা নিচ্ছেন। এইতো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে এমন বহু পার্ট টাইম ফটোগ্রাফারের দেখা মিলছে। অর্জিতা সূত্রধরের কথাই ধরা যাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই শিক্ষার্থী শখের বশেই ক্যামেরা কিনেছিলেন। ২০২৩ সালের দিকেই এই পথে যাত্রা তার।
শুরুর দিকে তো একেবারেই আনাড়ি ছিলেন অর্জিতা। তাই কাজ ভালো করার জন্য পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের ছবি তুলতেন। এভাবে করে আস্তেধীরে বিভিন্ন প্রোগ্রামে ছবি তুলতে শুরু করেন। বিভাগের শিক্ষক ও সিনিয়রদের কথায় বেশ কয়েকটা প্রোগ্রাম ও বড় বড় ইভেন্টেও ছবি তুলেছেন তিনি। তবে সবই বিনামূল্যে।
'শুরু থেকেই যদি পেইড ফটোগ্রাফি করতাম, তাহলে নতুন বেশ কয়টা লেন্সের টাকা উঠে যেত। ব্যাপারটা ভাবলেই আফসোস লাগে এখন। তার অনেক পরে একসময় বুঝতে পারি— ব্যাটারির কার্যক্ষমতা কমে আসছে, অন্তত ক্যামেরার যন্ত্রপাতি (যেমন- ব্যাটারি, মেমোরি কার্ড, নতুন লেন্স) কেনার জন্য অর্থের বিনিময়ে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফি শুরু করতেই পারি। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। খরচ যোগাতেই ফটোগ্রাফির মাধ্যমে টুকটাক আয়ের পথ বেছে নিই। আমি সাধারণত ঘণ্টা চুক্তিতে ৮০০ টাকা নিই। কোনো বিশেষ ইভেন্টের সময় হলে একটু বেশি রাখি', বলেন অর্জিতা।
যে নারীরা পুরুষ ফটোগ্রাফারদের সামনে ছবি তুলতে সংকোচ বোধ করেন, তাদের পছন্দে থাকে নারী ফটোগ্রাফাররা। তাই অনেক নারী গ্রাহকই চান নারীরাও যেন আসেন এ পেশায়।
অবশ্য ফটোগ্রাফিকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়ার চিন্তা নেই অর্জিতার। তিনি মনে করেন, খাটুনি সত্ত্বেও বেশিরভাগ মানুষ এখনো ছবি তোলার কাজে যথেষ্ট অর্থব্যয় করতে চায় না। যারা ফটোগ্রাফির কদর বোঝে, তারাই ভালো দাম দেয়। ছবি তোলার কাজে ঢালাওভাবে খরচ করার মানসিকতা এখনো বেশিরভাগের হয়ে ওঠেনি।
অর্জিতা বললেন, 'তবে এইটা সত্য যে, পার্ট টাইম ইনকামের জন্য ফটোগ্রাফি বেশ ভালো সোর্স। তাই এভাবে কাজ করে এগোনোর পরিকল্পনা আছে আপাতত।'
ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত