ক্যাসেটবন্দি পুরোনো স্মৃতিকে নতুন করে দেন তারা!

নব্বইয়ের দশকে শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানে হরহামেশাই দেখা যেতো ভিডিও রেকর্ডিং করা হচ্ছে। বিয়ের পরে সেই ভিডিও ভিএইচএস ক্যাসেটে করে দিয়ে দেওয়া হতো পাত্র-পাত্রী উভয় পক্ষের ঘরেই।
ঘরে টেলিভিশন আর ভিসিআর থাকলে সেই ক্যাসেট চালিয়ে বিয়ের দিনের ভিডিও সবাই একসাথে বসে দেখতেন। সিনেমার আদলে ভিডিও এডিটিং করে দেওয়া হতো—পাত্রকে ঘোড়ার ওপর বসিয়ে, পাত্রীকে পালকিতে বসিয়ে, কিংবা পাত্র-পাত্রীকে ফুলের ওপর ভাসিয়ে এডিট করে সাজানো হতো। পুরো বিয়ের অনুষ্ঠানের বিভিন্ন অংশের ভিডিও একসাথে জুড়ে দেওয়া হতো। ভিডিওতে থাকতো নানা রকম বিয়ের গানও।
বিয়ের পরে সেই ভিডিও বাসায় সবাই একসাথে বসে দেখা ছিল একধরনের উৎসব। যার বাসায় টিভি আর ভিসিআর থাকতো, সেখানে একদিন আয়োজন করে সবাই জড়ো হতেন। মুরব্বীরা সোফায়, আর বাচ্চারা মেঝেতে বসতো। আয়োজনের মধ্যমণি হিসেবে থাকতেন বর আর কনে।
এখনো বিয়েতে ভিডিওগ্রাফি করা হয়, তবে আগের দিনের সেই ভিসিআর বা ভিএইচএস ক্যাসেট হারিয়ে গেছে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায়। আগে মধ্যবিত্তদের ঘরে ঘরে ভিসিআর থাকলেও এখন একেবারেই পাওয়া যায় না এ জিনিস। ২০০৫ সালের পর থেকে ক্যাসেটের জায়গা নিয়েছে ব্লু-রে সিডি। এখন তো সিডিও ব্যবহৃত হয় না। পেনড্রাইভ, মেমোরি কার্ড কিংবা ক্লাউড ড্রাইভেই ছবি বা ভিডিও আদান-প্রদান করা হয়।
তবে নব্বইয়ের দশকের বিয়ের ভিডিওর ক্যাসেট এখনো অনেকের সংরক্ষণে আছে। কিন্তু ভিসিআর আর নেই। নষ্ট ভিসিআর এখন মেরামত করা হয় না। আধুনিক টেলিভিশনে ভিসিআর চালানোও সম্ভব নয়। ফলে হাজারো স্মৃতি ধরে রাখা পুরনো ভিএইচএস ক্যাসেটগুলো এখন শোকেস বা আলমারির তাকে পড়ে থাকে।
তবে আজকাল ঢাকা শহরের বেশ কিছু জায়গায় পুরনো ভিএইচএস ক্যাসেট থেকে বিশেষ কায়দায় ভিডিও বা ছবি নতুন করে উদ্ধার করা হচ্ছে। সেসব ভিডিও আধুনিক রূপে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে পেনড্রাইভ বা মেমোরি কার্ডে। এভাবেই পুরনো দিনের স্মৃতি নতুন করে নিচ্ছেন অনেকেই।
শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানের ভিডিও নয়—জন্মদিন, পিকনিক, প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান, ভিসিআরে রেকর্ড করা পুরনো দিনের নাটক কিংবা সিনেমা—সবই এখন ডিজিটাল ফরম্যাটে উদ্ধার করা সম্ভব।

কোথায় এবং কীভাবে
ঢাকার কয়েকটি জায়গায় পুরনো ক্যাসেট থেকে ভিডিও উদ্ধারের কাজ হচ্ছে। মূলত কিছু ছবি তোলার দোকানেই এ কাজটি করা হয়। মিরপুর, টিকাটুলি আর এলিফ্যান্ট রোডে এমন কয়েকটি দোকান রয়েছে।
এলিফ্যান্ট রোডের শেলটেক সিয়েরা মার্কেটের একটি দোকান, 'ব্যান্ড ওয়েডিং অ্যান্ড ফটোগ্রাফি'—এ ধরনের কাজ করে থাকে। এ দোকানের কর্ণধার মোল্লা সাইফুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে পুরাতন ভিএইচএস ক্যাসেটকে ডিজিটাল রূপে রূপান্তরের কাজ করছেন।
দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল শেলফে সারি সারি করে সাজানো নানা আকারের ক্যাসেট। পুরোনো এসব ক্যাসেটের ফিতার ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে না জানি কত মানুষের কত অমূল্য স্মৃতির মুহূর্ত!
মোল্লা সাইফুল বলেন, "প্রতি মাসে আমাদের কাছে ১২ থেকে ১৫ জন আসেন পুরোনো ক্যাসেট নিয়ে। তাদের ক্যাসেটের ভিডিওকে আমরা নতুন করে দেখার ব্যবস্থা করে দেই। এখন তো কারো বাসায়ই ভিসিআর নাই বলতে গেলে। কিন্তু আমাদের কাছে ভিসিআর, ভিডিও রেকর্ডার ক্যামেরা, সফটওয়্যার—সবই আছে। ফলে আমরা এই কাজগুলো করতে পারি।"

সাধারণত তিন ধরনের ক্যাসেট থেকে পুরোনো ভিডিও উদ্ধার করা হয়—ভিএইচএস, ভিএইচএস-সি আর মিনি ডিভি ক্যাসেট। ৯০-এর দশক থেকে একেক সময়ে একেকটি ক্যাসেট জনপ্রিয় ছিল। প্রথম দিকে বড় ভিএইচএস ক্যাসেটের চল বেশি ছিল। পরে ২০০০ সালের পর হ্যান্ড ক্যাম-রেকর্ডার জনপ্রিয় হলে মিনি ডিভি ক্যাসেট ব্যবহৃত হতে থাকে।
এই ক্যাসেটগুলোর ভেতরে থাকে কালো ফিতা। কেউ যখন পুরোনো ক্যাসেট নিয়ে আসেন, তখন প্রথম কাজ হয় সেই ক্যাসেট নির্ধারিত ডিভাইসে চালিয়ে ভিডিওর মান যাচাই করা।
এসব দোকানে এখনো ভিসিআর ও পুরোনো ক্যাম-রেকর্ডার রয়েছে। ভিএইচএস আর ভিএইচএস-সি ক্যাসেট চালানো হয় ভিসিআরে, আর মিনি ডিভির জন্য ব্যবহার করা হয় ক্যাম-রেকর্ডার।
কম্পিউটারের সাথে ভিসিআর ও ক্যাম-রেকর্ডার সংযুক্ত করা হয়। এরপর ক্যাসেটের ভিডিও কম্পিউটারে চালিয়ে দেখা হয়। যদি ভিডিওর মান মোটামুটি ভালো হয়, তখন 'ওবিএস সফটওয়্যার' নামের একটি ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে সম্পূর্ণ ভিডিওটি সম্পাদনা করা হয়।
কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ বছর আগের তৈরি এই ক্যাসেটের ভিডিও বেশিরভাগ সময়ই অস্পষ্ট থাকে। কিছু ভিডিও ঝিরঝির করে চলে, আবার কিছু ফেটে যায় বা ঝাপসা হয়ে যায়। সফটওয়্যার দিয়ে সম্পাদনার মাধ্যমে এসব ভিডিওকে যতটা সম্ভব স্পষ্ট করে তোলা হয়।

তবে কিছু কিছু ক্যাসেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশি পুরোনো হলে বা অযত্নে রাখলে এসব ক্যাসেটের ফিতা ছিঁড়ে যায়। অনেক সময় ক্যাসেটের ফাঁক দিয়ে ধুলাবালি ঢুকে ফিতায় আঁচড় পড়ে।
তবুও এমন ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাসেট থেকেও ভিডিও উদ্ধার করা সম্ভব। প্রথমে এসব ক্যাসেট খুলে ভেতরের সম্পূর্ণ রিলের ফিতা বের করা হয়। প্রয়োজন হলে ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু বা পুরো ফিতাই পরিষ্কার করা হয়।
এই পরিষ্কারের কাজটি করা হয় আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহলে ডুবিয়ে রেখে, পাতলা ব্রাশ দিয়ে। ক্যাসেটের রিলের ফিতা অত্যন্ত পাতলা ও স্পর্শকাতর হওয়ায় এ কাজ করতে হয় অত্যন্ত দক্ষ হাতে, নিপুণতার সাথে।
ফিতা শুকানোর পর আবার সেটিকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ক্যাসেটের ভেতরে ঢোকানো হয়। এরপর আগের নিয়মেই ভিসিআর বা ক্যাম-রেকর্ডারে চালিয়ে ভিডিও উদ্ধারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।

প্রতিটি ক্যাসেটের কাজ সম্পূর্ণ করতে চার থেকে পাঁচ দিন সময় লাগে। যদি ফিতা ক্ষতিগ্রস্ত বা ময়লা থাকে, তাহলে সময় আরও বেশি লাগে। একইসাথে খরচও কিছুটা বেড়ে যায়।
একটি পুরোনো ক্যাসেটের ভিডিও উদ্ধার করে তা সম্পাদনা করা একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। একেকটি ক্যাসেটের কাজ করতে খরচ পড়ে প্রায় এক হাজার টাকা। আর যদি ক্যাসেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে খরচ আরও বেশি হয়। সবকিছু নির্ভর করে ক্যাসেট কতটা ক্ষতিগ্রস্ত তার ওপর।
স্মৃতি ফিরে পেয়ে আনন্দিত তারা
টিকাটুলিতে বেশ কিছু দোকানে পুরোনো ক্যাসেট থেকে ভিডিও উদ্ধারের কাজ করা হয়। সেখানেই দেখা হলো সাদেক আলী সাহেবের সঙ্গে। কয়েকটি পুরোনো ক্যাসেট দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন—পুরোনো স্মৃতিগুলো আবার নতুন করে ফিরে পাবেন বলে।

কবেকার ভিডিও উদ্ধার করছেন? জানতে চাইলে তিনি বললেন, "আমি ১৯৯৩ সালে বিয়ে করেছি। ওই সময় বিয়েতে ভিডিও করার ট্রেন্ড শুরু হয়েছিল। আমাদের বিয়েতেও ভিডিও করা হয়। এতদিন ক্যাসেটগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। কিছুদিন আগে এক জায়গায় দেখলাম পুরোনো ক্যাসেটের ভিডিও উদ্ধার করা হয়। তাই নিয়ে এসেছিলাম এগুলো। আজ হাতে পেতে যাচ্ছি। অনেক ভালো লাগছে।"
পুরোনো ক্যাসেটের স্মৃতি উদ্ধার হলে অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। মারা যাওয়া আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো আবার নতুন করে দেখতে চান অনেকেই।
সেখানকার এক দোকানের এক কর্মচারী বলেন, "আমাদের কাছে একজন একটা ক্যাসেট নিয়ে এসেছিলেন। কাজ শেষ হওয়ার পর ভিডিও দেখার সময় উনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। উনার বাচ্চার জন্মদিনের ভিডিও ছিল ওখানে। বাচ্চাটা ছোটবেলাতেই এক্সিডেন্ট করে মারা গিয়েছিল।"
পুরোনো স্মৃতি নতুন করে ফিরে পেতে কার না ভালো লাগে?

বিদেশে এভাবে পুরোনো ছবি বা ভিডিও পুনরুদ্ধারের কাজ অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। আমাদের দেশেও এখন নতুন করে এ ধরণের কাজ শুরু হয়েছে। আগের প্রজন্মের অনেকেই এই উদ্যোগকে সাদরে গ্রহণ করছেন।
জেন-জি প্রজন্মের কাছে মোবাইল ফোনে এক আঙুলের টোকায় ছবি তোলা বা ভিডিও করা, তা মুছে গেলে সহজেই রিসাইকেল বিন থেকে উদ্ধার করা, কিংবা ড্রাইভে সংরক্ষণ করা—সবই খুব সহজ। কিন্তু ছবি বা ভিডিওর সঙ্গে যে এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা আমাদের আগের প্রজন্মই সবচেয়ে ভালোভাবে অনুভব করতে পারেন।
ছবি: ফাইয়াজ আহনাফ সামিন/টিবিএস