নকশি কাঁথা: প্রতিটি সেলাইয়ে ফুটে ওঠা ঐতিহ্য আর পরিচয়ের গল্প
মাগুরা পাড়া গ্রামের জরিনা বেগম বন্ধুদের সঙ্গে বসে আছেন নিজেদের বাড়ির সামনের উঠোনে। পুরোনো চালের বস্তা সেলাই করে বানানো মাদুরে পিঁড়ি পেতে বসে গল্প আর হাসির ভেতরেও হাত থেমে নেই তাদের। সূঁচ আর সুতোয় কাপড় বুনে একটির পর একটি রঙিন কাঁথা তৈরি করছেন তারা। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে নকশি কাঁথার শিল্প—এক চিরন্তন ঐতিহ্য।
এই প্রাচীন সেলাইশিল্প আবার নতুন করে জনপ্রিয়তা ফিরে পাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ বা ভারতেই নয়, আজ নকশি কাঁথার দেখা মিলছে বিশ্বের নানা প্রান্তের জাদুঘরে, ক্যাটওয়াকে কিংবা বুটিকে।
বিশ্বজুড়ে এই আগ্রহের পেছনে আছে অনলাইন কেনাকাটার সহজলভ্যতা, পুনঃব্যবহার বা আপসাইক্লিং-এর নতুন ঢেউ এবং পরিবেশ সচেতনতার প্রতি মানুষের বাড়তে থাকা টান।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক 'কাঁথা বে' নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস্টা সারটিন এ প্রসঙ্গে বলেন, এর পেছনে আরও একটি কারণ আছে—আশা। সারটিন বলেন, 'আশা এখন ভাইরাল। এই আশাই হল সেই সেতু, যা এই পবিত্র শিল্পকর্মগুলোকে সাংস্কৃতিক সীমা পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে।'

নকশি কাঁথা শুধু একটি শিল্প নয়, এটি বাংলার ইতিহাস আর সংস্কৃতির গল্প। শত শত বছর ধরে বাংলা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এখানকার সাহিত্য, শিল্প, সুতা-মসলিনের খ্যাতি ছিল দূর দূরান্তে। আর নকশি কাঁথা সেই গৌরবের এক উত্তরাধিকার।
নকশি কাঁথা সেলাই কী?
প্রথাগত নকশি কাঁথা হলো গ্রামবাংলার ঘরের নারীদের হাতে তৈরি একধরনের কম্বল বা চাদর। 'নকশি' মানে শৈল্পিক আঁকিবুঁকি, আর 'কাঁথা' মানে পুরোনো কাপড়ের কম্বল। যদিও সংস্কৃত শব্দ 'কান্থা' থেকে এর উৎপত্তি, যার অর্থই পুরোনো কাপড়। কয়েকটি পুরোনো শাড়ির স্তর একসঙ্গে জোড়া দিয়ে তৈরি হয় একটি কাঁথা। আর সেই কাঁথায় সূঁচ-সুতোয় ফুটে ওঠে তাদের দৈনন্দিন জীবন, লোককথা কিংবা ব্যক্তিগত স্মৃতির ছবি।
এই শিল্প মা থেকে মেয়ে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে এসেছে। সময়ের সঙ্গে বদলেছে এর ধরণ, রঙ, উপকরণ। বদলেছে ট্রেন্ড, উপকরণ এবং শিল্পীদের চাহিদা।

নকশি কাঁথা নিয়ে বই লিখেছেন সমাজকর্মী মালেকা খান। তিনি বলেন, প্রথম দিকে কাঁথা তৈরি হতো মূলত শীত কিংবা বর্ষার সময় গায়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই কাপড়ের প্রতিটি ফোঁড়ে জুড়ে বসে গেছে ভালোবাসা, স্মৃতি, আর জীবনের গল্প। প্রতিটি কাঁথা যেন হয়ে উঠেছে এক একটি পরিবারের ব্যক্তিগত ইতিহাস।
মালেকা বলেন, 'গ্রামের নারীরা খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পুরোনো শাড়িগুলোকে নতুন রূপ দিতেন। সুন্দর রঙিন পার গুলো কেটে রেখে দিতেন, সেগুলো দিয়ে পরে সূচিকর্ম করতেন। ইউরোপীয় ক্রেতারা বরাবরই বাংলার সুতা আর রেশমের মানের প্রতি আকৃষ্ট ছিল।'
তার বইয়ের পাতা উল্টে তিনি দেখান ১৯শ শতকের প্রথম দিকের কিছু নকশি কাঁথা—যেগুলোয় ফুটে উঠেছে পুরাণ, লোকগাথা, আধুনিক জীবনের দৃশ্য, এমনকি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা কিংবা রথযাত্রার ছবিও। শিল্পী যেই গল্প বলতে চেয়েছেন, সেই অনুযায়ী ফুটে উঠেছে পদ্মফুল, শঙ্খ কিংবা সূর্য।

তিনি বলেন, পুরোনো কাপড়গুলোর একটি জাদুকরী উদ্দেশ্যও ছিল। বিশ্বাস করা হতো, পুরোনো কাপড় দিয়ে তৈরি এসব কাঁথা কুনজর থেকে রক্ষা করে, দূরে রাখে অশুভ শক্তিকে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, একটিও কাঁথা আরেকটির মতো হয় না। প্রতিটি কাঁথা এক একটি অদ্বিতীয় শিল্প।
মালেকা খান বলেন, 'এই যে এক একটা কাঁথা এক এক রকম, এটাই তো জাদু। আমি পৃথিবীর আর কোথাও এমন শিল্প দেখিনি।'
নকশি কাঁথার ইতিহাস
নকশি কাঁথার প্রচলন প্রাচীন বৈদিক যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০-এর আগের) শুরু হয়। কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে এর উল্লেখ রয়েছে। তিনি লিখেছেন, চৈতন্যদেবের মা পুরীতে বসবাসরত তার ছেলেকে নিজ হাতে সেলাই করা একটি কাঁথা পাঠিয়েছিলেন।
বঙ্গ বিভিন্ন সাম্রাজ্যের শাসনের অধীনে ছিল, যেমন মৌর্য, গুপ্ত এবং মুঘল সাম্রাজ্য। এবং পরবর্তীতে এটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হওয়ার পর, বঙ্গ দুটি অংশে বিভক্ত হয়– পশ্চিমবঙ্গ (ভারতের অংশ) এবং পূর্ববঙ্গ (যা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়)। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়, যার ফলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
বাংলাদেশে নকশি কাঁথার ঐতিহ্য এখনও সবচেয়ে শক্তিশালী। এবং সময়ের সাথে বঙ্গভূমির সীমানা পরিবর্তিত হওয়ার মতো নকশি কাঁথাও শতাব্দী ধরে পরিবর্তিত হয়েছে। তবে এর প্রতীকী সূচিকর্ম অক্ষুণ্ন রয়েছে। বর্তমানে নকশাগুলো আগের থেকে সাধারণত আরও সরল হয়েছে।
মালেকা খান বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কাঁথা এক অনন্য ও অজানা ভূমিকা রেখেছিল। যখন লাখো মানুষ প্রাণে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিল, তারা নিজেদের গৃহসম্পদ পুরোনো কাপড়ের তৈরি কাঁথার ব্যাগে ভরে নিয়ে যেত। আহতদের শরীরে কাঁথা জড়ানো হতো, কাঁথা দিয়ে বানানো হতো প্রাথমিক চিকিৎসার উপকরণ।
তখন সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন মালেকা। যুদ্ধের ভয়াবহতায় ভেঙে পড়া নারীদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে দেখেছেন, যেসব নারী মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতেন না, তারা সূচিকর্মে ফিরে পেতেন এক ধরনের প্রশান্তি।
আজকের নকশী কাঁথা
আজকাল নকশি কাঁথা নতুন করে পরিচিতি পেয়েছে। স্থানীয় এবং বৈশ্বিক উভয় ক্ষেত্রেই এর বাণিজ্যিক চাহিদা বেড়েছে। তবে এখন এগুলো পুরোনো শাড়ির পরিবর্তে সাধারণত নতুন সুতি কাপড়ে তৈরি করা হয়। যদিও একক সূচিকর্ম এই শিল্পের মূল ভিত্তি, নকশাগুলোগুলি প্রায়ই কাপড়ে আঁকা হয় এবং তারপর তার ওপরে সূচিকর্ম করা হয়। এভাবে, দ্রুততার সাথে এবং সস্তায় উৎপাদন করা সম্ভব হয়।
তবে পুরান নকশী কাঁথার প্রচলন এখনও রয়েছে। গ্রামীণ শহরগুলোতে এখনও নকশী কাঁথা পাওয়া যায়, দশকের পর দশক ধরে সেলাই করা কাথাগুলোতে থাকা নকশা আর কাপড়ের স্তর অনেক গল্প জমিয়ে রাখে।
জামালপুর জেলা দেশের বিভিন্ন নকশী কাঁথা উৎপাদন কেন্দ্রের মধ্যে একটি। অন্যান্য উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর মতো, উদ্যোক্তারা আশপাশের গ্রাম থেকে ১০০ জন মহিলাকে দিয়ে কাজ করান। তাদেরকে ইতোমধ্যেই প্রস্তুত করা সেঁটে দেওয়া তুলার কাপড় এবং সুতা সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি কাঁথার জন্য মজুরি দেওয়া হয়। তারপর সেগুলো ধুয়ে, প্যাকেজিং করে সমগ্র দেশে বিতরণ করা হয়।
বাংলাদেশের জামালপুর জেলা, যেখানে জরিনা বেগম এবং তার বন্ধুরা বসে কাঁথা সেলাই করেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নকশি কাঁথা তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। অন্যান্য কেন্দ্রগুলোর মতো, এখানে উদ্যোক্তারা কাছাকাছি গ্রামের ১০০ জন নারীকে কাঁথা তৈরির জন্য নিয়োগ দেন। তারা এসব নারীদের আগে থেকেই স্টেন্সিল করা কাপড় এবং সুতা সরবরাহ করেন এবং প্রতিটি কাঁথার জন্য তাদের পারিশ্রমিক দেন। এরপর, ওই নারীরা কাঁথাগুলো ধুয়ে, প্যাকেজিং করে তা দূরবর্তী অঞ্চলে পাঠান।
সুলতান মাহমুদ এমন একজন উদ্যোক্তা, যিনি ৩০ বছর আগে জামালপুরে খালি হাতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, 'আমার কাছে ছিল শুধু পরনের লুঙ্গি এবং একটি শার্ট। আমি ধীরে ধীরে ব্যবসা শুরু করি।' আজ তার ব্যবসা সফল এবং বর্তমানে তিনি জামালপুর নকশি কাঁথা কোঅপারেটিভের সহ-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিমাসে তিনি কমপক্ষে ৫ হাজার কাঁথা বিক্রি করেন।

নকশি কাঁথার চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারীদের ক্ষমতায়ন এবং কর্মসংস্থানে এর অবদান বৃদ্ধি পেয়েছে। জামালপুরের কাছাকাছি বসবাসরত মিতু বাসফোর তার অবসর সময়ে সুলতান মাহমুদের জন্য কাঁথা তৈরি করেন। তিনি বলেন, 'আমি যে টাকা আয় করি কাঁথা বিক্রি করে, তা দিয়ে আমার সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারি। এটা অনেক ভালো লাগে।' যে দেশে নারীরা অনেক সময় আর্থিকভাবে স্বাধীন নন, পরিবারে অবদান রাখার এই সুযোগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত এনজিও বাসা-এর মূল অফিসে নারীরা তাদের সাপ্তাহিক সময় কাটান কাপড় বিছিয়ে এবং কাঁথা সেলাই করে। আর তাদের ছোট ছোট সন্তানদের জন্য পরিচর্যার ব্যবস্থা থাকার পাশাপাশি ও স্কুলে পাঠদান করা হয়। এতে নারীদের ওপর থেকে এক ধরনের বোঝা কমে যায় এবং তারা আয় করতে পারেন। খুচরা বিক্রেতারা এই এনজিও থেকে অনলাইনে পণ্য কেনে, এবং তাদের পণ্য বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়।
বাসা-এর প্রতিষ্ঠাতা রবিন সাইফার্ট-এর তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে নকশি কাঁথার পুনরুজ্জীবনের অন্যতম কারণ ছিল গ্রাহকদের মধ্যে একটি বৈশ্বিক প্রবণতা, যেখানে তারা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত, নৈতিকভাবে তৈরি পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন। তিনি বলেন, 'প্রতিটি কাঁথা অনন্য, যা দোকানের শেলফে থাকা বৃহৎ পরিমাণে উৎপাদিত পণ্য থেকে অনেক দূরে, সেটাই তাদের আবেদন।'
পুনঃপ্রক্রিয়াজাত উপকরণের ব্যবহার এক ধরনের বোনাস। পরিবেশবান্ধব পণ্য বিক্রি হয়। বাসার পণ্যগুলো প্রায় একচেটিয়াভাবে অনলাইনে বিক্রি হয়—এস্তোনিয়া থেকে হংকং, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। তারা ঐতিহ্যবাহী কাঁথা বিক্রি করে। তবে এই ধারণাটি আধুনিকীকরণের মাধ্যমে তারা অন্যান্য সেলাই করা পণ্য যেমন জ্যাকেট এবং ব্যাগও বিক্রি করছে। সাইফার্ট বলেন, 'এখন বিশ্বব্যাপী পণ্য পাঠানো এবং সংযোগ স্থাপন করা অনেক সহজ।'
পুরোনো বা আধুনিক, নকশি কাঁথা এখনও বাংলা অঞ্চলের এবং এখানকার মানুষের একটি সুন্দর প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে, যা সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে। এবং আধুনিক প্রবণতা ও বাজারের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়