পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন নিঃস্ব অবস্থায়, আজ তার নাতি ৩,১০০ কোটি টাকার সুপারস্টার
ভারতীয় বিনোদন জগতে রোশন পরিবার এক জনপ্রিয় নাম। ঋত্বিক রোশন, রাকেশ রোশন বা রাজেশ রোশনের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্ল্যামারের ছবি। কিন্তু এই রাজকীয় অধ্যায়ের ভিত্তি যার হাতে গড়া, তিনি ছিলেন এক স্বপ্নবাজ সুরসাধক। তিনি আর কেউ নন, ঋত্বিক রোশনের দাদা—রোশন লাল নাগরথ।
১৯১৭ সালের ১৪ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালায় (বর্তমান পাকিস্তান) জন্ম রোশন লালের। ছোটবেলা থেকেই সুর আর ছন্দের প্রতি ছিল তাঁর অদ্ভুত টান। গানের টানেই লখনৌয়ের ম্যারিস কলেজে ভর্তি হন, সেখানে পণ্ডিত এস এন রতনজঙ্করের কাছে ধ্রুপদী সঙ্গীতের তালিম নেন। এরপর নিজেকে আরও শানিয়ে নিতে মাইহারের কিংবদন্তি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-র কাছে শেখেন সরোদ।
১৯৪০ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওর দিল্লি কেন্দ্রে এসরাজ বাদক হিসেবে চাকরি পান তিনি। কিন্তু রেডিওর চারদেয়ালে তাঁর মন টিকল না। আট বছর পর, ১৯৪৮ সালে চাকরি ছেড়ে বোম্বে (মুম্বাই) পাড়ি জমান সিনেমার সুরকার হওয়ার স্বপ্নে।
বোম্বেতে কঠিন দিনলিপি
বোম্বেতে এসে শুরু হলো আসল লড়াই। হাতে কাজ নেই, পকেটে টাকা নেই। ভালোবেসে বিয়ে করায় পরিবার থেকেও তেমন সাহায্য মেলেনি। একপ্রকার গৃহহীন, বেকার অবস্থায় দিন কাটছিল তাঁর। সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করলেও ভাগ্য ফিরছিল না।
অবশেষে তাঁর মেধা আর বিনয় নজরে পড়ে পরিচালক কিদার শর্মার। তিনি রোশনকে 'নেকি ঔর বদি' (১৯৪৯) সিনেমায় সুর পরিচালনার সুযোগ দেন। ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি। কিন্তু কিদার শর্মা হাল ছাড়েননি। তিনি রোশনকে দ্বিতীয় সুযোগ দেন। ১৯৫০ সালে মুক্তি পায় 'বাউরে নেইন'। এই ছবির গানের জাদুতে রোশন লাল হিন্দি সিনেমায় নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করেন। কিদার শর্মা পরে বলেছিলেন, রেডিওর চাকরি ছেড়ে রোশন তখন গৃহহীন অবস্থায় ঘুরছিলেন, তাঁর সেই সততাই পরিচালকের মন ছুঁয়েছিল।
সফলতার সিঁড়িতে
পঞ্চাশের দশকের শুরুতে মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, তালাত মাহমুদের মতো শিল্পীরা তাঁর সুরে গান গাইতে শুরু করেন। 'মালহার', 'শিশম' বা 'আনহোনি'-র মতো সিনেমায় তিনি সুরের বৈচিত্র্য দেখান। ১৯৫২ সালের 'নওবাহার' সিনেমায় লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ভজনটি সারা দেশে জনপ্রিয়তা পায়।
তবে ষাটের দশক ছিল রোশন লালের ক্যারিয়ারের স্বর্ণযুগ। লোকসংগীতের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মিশেলে তিনি এক নতুন ধারা তৈরি করেন। ১৯৬০ সালের 'বরসাত কি রাত' সিনেমার কালজয়ী কাওয়ালি ও রোমান্টিক গানগুলো তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেয়। ছবিটি ছিল ওই দশকের অন্যতম বড় হিট, যার কৃতিত্ব অনেকটাই ছিল রোশনের সুরের।
অকাল বিদায় ও রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার
ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৪৮ সালে ইরা মৈত্রকে বিয়ে করেন তিনি। বোম্বেতে গড়ে তোলেন নিজের সংসার। তাদের ঘর আলো করে আসে দুই ছেলে—রাকেশ ও রাজেশ রোশন।
পেশাগত জীবনে যখন সাফল্যের তুঙ্গে, তখনই শরীরে বাসা বাঁধে অসুখ। প্রায় দুই দশক ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন। শেষরক্ষা হয়নি। ১৯৬৭ সালের ১৬ নভেম্বর মুম্বাইয়ের এক পার্টিতে হার্ট অ্যাটাকে মাত্র ৫০ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান এই গুণী শিল্পী।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে
রোশন লাল চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর সুরের মশাল নিভে যায়নি। ছেলে রাকেশ রোশন নামকরা পরিচালক ও প্রযোজক হয়েছেন, আরেক ছেলে রাজেশ রোশন হয়েছেন সফল সুরকার।
আর দাদুর সেই শৈল্পিক উত্তরাধিকার এখন বহন করছেন নাতি ঋত্বিক রোশন। 'কহো না প্যায়ার হ্যায়', 'ধুম ২' বা 'যোধা আকবর'-এর মতো সিনেমা দিয়ে ঋত্বিক নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি এখন ভারতের অন্যতম সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতা।
জিকিউ ইন্ডিয়ার তথ্যমতে, ঋত্বিকের বর্তমান সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩,১০০ কোটি টাকা। দাদার সেই সংগ্রামের ফসল আজ নাতি ভোগ করছেন। শুধু সিনেমা নয়, ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্ট থেকেও তিনি প্রচুর আয় করেন। তাঁর নিজের ফিটনেস ব্র্যান্ড 'এইচআরএক্স'-এর মূল্যই ২০০ কোটি টাকা। এছাড়া জুহুতে ১০০ কোটি টাকার বাড়ি, লোনাভালায় ৩৩ কোটি টাকার খামারবাড়ি এবং বিভিন্ন স্টার্টআপে বিনিয়োগ মিলিয়ে ঋত্বিক গড়ে তুলেছেন এক বিশাল সাম্রাজ্য।
একসময় যে রোশন লাল কাজের খোঁজে গৃহহীন অবস্থায় ঘুরেছেন, আজ তাঁর নামেই দাঁড়িয়ে আছে বলিউডের অন্যতম প্রভাবশালী এই পরিবার।
