২ বছরে তৈরি পানির নিচের সেট—‘মিশন ইমপসিবল’-এ দমবন্ধ করা স্টান্টে টম ক্রুজ

১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'লেজেন্ড' চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো পানির নিচে অভিনয় করেন টম ক্রুজ। এরপর ২০১৪ সালের 'এজ অব টুমোরো'তে করেন আরও দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্স। তবে সবচেয়ে আলোচিত ছবি ছিল 'মিশন: ইমপসিবল- রোউগ ন্যাশন'—যেখানে তিনি একটানা ছয় মিনিট ৩০ সেকেন্ড পানির নিচে দম বন্ধ অবস্থায় ছিলেন।
তবে সম্প্রতি লেখক ও পরিচালক ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়েরি ফিল্মমেকার টুলকিট পডকাস্টে এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলেন—রোউগ ন্যাশনের সেই পানির নিচের দৃশ্য নিয়ে তারা দু'জনেই চরম হতাশ ছিলেন।
ম্যাককুয়েরি বলেন, 'পানির নিচে শুটিং করা অত্যন্ত কঠিন এবং হতাশাজনক কাজ।' তিনি এক পর্যায়ে আর কখনও পানির নিচে দৃশ্য ধারণ করবেন না বলেও কসম খেয়েছিলেন।
তিনি জানান, ওই দৃশ্য ধারণে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল সময়। রোউগ ন্যাশন-এর পানির ট্যাংকে তারা দিনে মাত্র ছয়টি শট নিতে পারতেন। এছাড়াও পুরো দৃশ্যের নকশাতেও বেশ কিছু ভুল ছিল—বিশেষ করে এতে ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস বা সিজিআই-র ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা।
এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই টম ক্রুজ ও ম্যাককুয়েরি তাদের মিশন ইমপসিবলের শেষ কিস্তি 'দ্য ফাইনাল রেকনিং'-এ নতুনভাবে পানির নিচের দৃশ্য শ্যুট করেন।
সিনেমার কাহিনিতে ইথান হান্ট (টম ক্রুজ) বিশ্বের ধ্বংস ঠেকাতে 'দ্য সেভাস্তোপল' নামে একটি রুশ সাবমেরিনে প্রবেশ করেন, যা বরফে ঢাকা বেরিং সাগরের গভীরে ডুবে রয়েছে। সেখানে রাখা 'পদকোভা' নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র উদ্ধার করাই তার লক্ষ্য, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ভিলেন 'দ্য এনটিটি'র হাত থেকে পৃথিবী রক্ষার একমাত্র উপায়।
ম্যাককুয়েরি বললেন, 'এইবার আমরা আরও বাস্তবধর্মী কিছু করতে চেয়েছি। কম সিজিআই, কম গ্রিন স্ক্রিন—সব কিছু যেন বাস্তব মনে হয়।'
তিনি বলেন, 'আমরা সব সময় চেষ্টা করি পূর্বের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও বাস্তবসম্মত, কম ভার্চুয়াল, কম সিজিআই, কম গ্রিনস্ক্রিন ব্যবহার করে কাজ করতে। রোউগ ন্যাশন-এর সেট ডিজাইন এবং দৃশ্যের কনসেপ্ট আমাদের সেসবের বিপরীত ছিল। তাই আমরা এজ অব টুমোরো-এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাই রোউগ ন্যাশন-এ, আর এরপর সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিখে নতুনভাবে পরিকল্পনা করি ফাইনাল রেকনিং-এর জন্য।'

পরিচালক নিজেই নামলেন পানির নিচে
'এই ছবির সবচেয়ে বড় অগ্রগতি ছিল যখন আমি নিজে পানির নিচে নামলাম,' বললেন ম্যাককুয়ারি।
'সাধারণত যখন কেউ পানির নিচের কোনো দৃশ্য পরিচালনা করেন, তখন পরিচালক পানির ওপরে থাকেন এবং একজন সহকারী পরিচালক মাইক্রোফোনের মাধ্যমে পানির নিচে সবাইকে নির্দেশ দেন। অর্থাৎ, আপনি সরাসরি না দাঁড়িয়ে তৃতীয় একজনের মাধ্যমে পরিচালনা করেন।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি পানির নিচে নামায় দৈনিক শটের সংখ্যা ছয় থেকে বেড়ে ২২-এ দাঁড়ায়। উপরে দাঁড়িয়ে শুধু ক্যামেরা মনিটরে দেখে শট বোঝা অনেক সীমাবদ্ধ। সেটা এমন এক অভিজ্ঞতা, যেন বক্সিং গ্লাভস পরে পকেটঘড়ি সারানোর চেষ্টা করছেন।'
দুই বছর ধরে বানানো হয় পানির নিচের সেট
ফাইনাল রেকনিং-এর দৃশ্যের জন্য তৈরি করা হয় কৃত্রিম সাবমেরিনের একটি সেট, যেখানে কিছু চেম্বার সম্পূর্ণ শুকনো আর কিছু পানি দিয়ে ভরা। ফলে একটি দরজা খোলা মাত্রই প্রবল বেগে পানি অন্য চেম্বারে ঢুকে পড়ে, তৈরি হয় প্রবল স্রোত ও ভ্যাকুয়াম [বায়ুশূন্য] প্রভাব।
এই সাবমেরিনটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন এটি সমুদ্রের তলদেশে একটি ঢালের কিনারায় আটকে আছে। পানির চাপ ও ভারসাম্যের কারণে এটি কখনো হেলে পড়ে, আবার কখনো ভারসাম্য ফিরে পায়। এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যেই টম ক্রুজকে সাবধানে পেরোতে হয়েছে বিশাল টর্পেডোর মধ্যবর্তী সরু পথ, পৌঁছাতে হয়েছে সাবমেরিনের সনার কক্ষে।
এই দৃশ্যের জন্য পৃথিবীর কোথাও প্রস্তুত কোনো শুটিং সেট ছিল না। তাই নির্মাতাদের তৈরি করতে হয়েছে পুরোপুরি নতুনভাবে নির্মিত পানির ট্যাংক, সাবমেরিন সেট এবং একটি বিশেষ গিম্বল—যেটি ছিল এক হাজার টনের একটি ইস্পাতের কাঠামো। এটি ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরতে পারে এবং ৪৫ ডিগ্রি পর্যন্ত দুলতে পারে, যা পুরো দৃশ্যকে বাস্তবতার কাছাকাছি নিয়ে গেছে। এই সেটটি প্রয়োজনে সাড়ে ৮ মিলিয়ন লিটারের পানিতে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে ফেলা যেত। এত জটিল প্রস্তুতি ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে দৃশ্যটি তৈরি করতে নির্মাতা দলের লেগেছে পুরো দুই বছর।
জীবন বাজি রেখে স্টান্ট
১৪০ মাইল গতির একশো বছর পুরনো বাইপ্লেনের পাখায় দাঁড়িয়ে স্টান্ট করার তুলনায়, পানির ওপরে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির সাবমেরিন দৃশ্যকে অনেকেই কম বিপজ্জনক মনে করতে পারেন। কিন্তু 'দ্য ফাইনাল রেকনিং'-এর নির্মাতা ক্রিস্টোফার ম্যাককোয়ারির মতে, বিষয়টা মোটেও তেমন নয়।
ফিল্মমেকার টুলকিট পডকাস্টে কথা বলার সময় ম্যাককোয়ারি জানান, 'দ্য ফাইনাল রেকনিং'-এর সাবমেরিন এবং বিমান দৃশ্য—এই দুটি ছিল মিশন ইমপসিবল সিরিজের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়, কঠিন এবং বিপজ্জনক শুটিং সিকোয়েন্স।
জলমগ্ন সেটটির ঘূর্ণায়মান কাঠামো নিয়ে ম্যাককোয়ারি বলেন, 'ইঞ্জিনিয়াররা আমাদের জানিয়েছিল কতটা দ্রুত সেটটি ঘোরাতে পারবে এবং তাদের হিসেব সঠিক ছিল। কিন্তু সেটের ভেতরে গিয়ে না দাঁড়ালে কেউ বুঝতেই পারত না সেটার ভেতরে শুটিং করা কতটা কঠিন হতে পারে। কেউই আগেভাগে আন্দাজ করতে পারেনি সেই ঘূর্ণনের সঙ্গে সৃষ্ট প্রবাহ আর কৃত্রিম বৃষ্টির জটিলতা।'
স্টান্ট কো-অর্ডিনেটর ওয়েড ইস্টউড ও তার দল শুটিং শুরুর আগে বেশ সময় নিয়েছেন সাবমেরিনের পানিপূর্ণ সেটটির সঙ্গে মানিয়ে নিতে।
শুটিংয়ের আগে স্টান্ট কো-অর্ডিনেটর ওয়েড ইস্টউড ও তার দল অনেক সময় ধরে সেটটি নিয়ে মহড়া করেছেন, যাতে সবাই জানে কীভাবে সেটটি কাজ করে এবং কোথায় বিপদ হতে পারে।
ইস্টউড বলেন, 'প্রথম দিকে আমরা ধীরে ধীরে সেটটিকে ঘুরাতাম, কিছুটা কাত করতাম, তারপর সেটি পানিতে ডুবত। কিন্তু সেটটি যখন পানিতে নড়াচড়া করে, তখন পানির মধ্যে প্রচণ্ড স্রোত আর বুদবুদ তৈরি হতো, যা আমাদের পানির নিচের যন্ত্রগুলোর দিকে টেনে নিয়ে যেত। সেই যন্ত্রপাতিগুলোর পাশে থাকা খুবই বিপজ্জনক ছিল।'

যদিও টরপেডোগুলো ছিল প্রপ বা কৃত্রিম, কিন্তু এগুলোর ওজন ছিল প্রায় বাস্তবের মতোই। কারণ, হালকা করলে পানির মধ্যে এগুলোর গতিবিধি অস্বাভাবিক দেখাত। আর দর্শক তা সহজেই ধরে ফেলত।
ইস্টউড বলেন, 'আমরা প্রপগুলোকেকে বাস্তব রাখতে চেয়েছি, তবে সেটা করতে গিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে পরীক্ষা করতে হয়েছে যেন কোন কিছু হঠাৎ আটকে না যায় বা ভুল জায়গায় পড়ে না যায়—বিশেষ করে টমের পথের সামনে। ধরুন, যদি টম পানির নিচে থাকে আর একটা টরপেডো হঠাৎ ওপর থেকে পড়ে যায়—তা হলে সেই ভারী বস্তুটা ওজনহীন হলেও সেটি যদি ভুল সময়ে টমের ওপরে এসে পড়ে, তাকে মারাত্মকভাবে আহত করতে পারে।'
ম্যাককোয়ারি, টম ক্রুজ, ইস্টউড এবং ক্যামেরা টিম সবাই হাতের ইশারা দিয়ে কথা বলতেন, আর জটিল কিছু বোঝাতে ব্যবহার করতেন পানির নিচে লেখার উপযোগী বোর্ড। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বুদবুদ আর পানির ধাক্কায় অনেক সময় টমকে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে ফেলা।

ম্যাককোয়ারি বলেন, 'পানির ভেতরে ঘূর্ণি, ধ্বংসাবশেষ, আর ঝাঁকুনিতে টমকে অনেক সময় আমরা দেখতে পেতাম না। তখন পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক হয়ে যেত।'
ইস্টউড বলেন, 'সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার ছিল, কখন যে টম সত্যি বিপদে পড়েছে আর কখন অভিনয় করছে, সেটা আলাদা করে বোঝা যায় না। আমরা এক দৃশ্যে অস্থিরতা দেখাচ্ছি—একটা টরপেডো এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ঠেলে দিচ্ছে, সে ফেঁসে যাচ্ছে। পরিকল্পনায় ছিল সে ৩ থেকে ৪ সেকেন্ডের জন্য আটকে থাকবে, কিন্তু সে ১০-১২ সেকেন্ড ধরে নিচে থেকেই অভিনয় করে যাচ্ছে। আমাদের সংকেত আছে যদি সে বিপদে পড়ে, কিন্তু এই সময়টা খুবই দুশ্চিন্তার। ও তাৎক্ষণিকভাবে কিছু তৈরি করছে, অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা দেখে মনে হচ্ছে সে সত্যিই ডুবে যাচ্ছে, আটকে গেছে।'
তিনি যোগ করেন, 'অনেক সময় আমার মনে হয়েছে দৌড়ে গিয়ে ওকে উদ্ধার করি। আর সত্যিই কিছু সময় আমি সেটা করেছি। আমি যখন টমকে টেনে তুলতে গেছি, তখন ও বলেছে, "কী করছো তোমরা? আমি তো অভিনয় করছিলাম!" মাঝে মাঝে এটা আমার জন্য খুবই কঠিন হয়ে উঠেছিল।'