গুরুত্বপূর্ণ কিছু শ্রম সংস্কার সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে, বাকি আছে অনেকগুলো
শ্রম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর গত আট মাসে তাদের সুপারিশের কিছু বড় সংস্কার হয়েছে। আবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শ্রম আইন সংশোধন, তিন বছর পরপর মজুরি পর্যালোচনা করা (যা এতদিন ৫ বছর ছিল), কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা বাড়ানোর পদক্ষেপ ও ট্রেড ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়া সহজ করার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে।
কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রাানি ও সহিংসতা রোধে বহুল আলোচিত আইএলও কনভেনশন ১৯০-সহ তিনটি কনভেনশন রেটিফাই করার সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়েছে।
এছাড়া গৃহকর্মীর মতো কিছু অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা শ্রম আইনের সুবিধার আওতায় এসেছেন; কারখানার কর্মীরাও শ্রম আইনের আওতায় সুবিধা প্রাপ্য হবেন।
অবশ্য এর বাইরে বড় একটি অংশ বাস্তবায়ন হয়নি। ন্যূনতম মজুরি কাঠামো সংস্কার, জাতীয় ন্যূনতম মজুরি মানদণ্ড স্থির করা, 'লিভিং ওয়েজ' ধারণা অন্তর্ভুক্ত করা, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস করা, শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীর বিরুদ্ধে দায়ের করা ফৌজদারি মামলা দ্রুত পর্যালোচনা করে বাতিল করার সুপারিশ থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
এছাড়া শ্রম আদালতের সক্ষমতা বৃদ্ধি, জবরদস্তিমূলক শ্রমের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির বিধান যুক্ত করা, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কর্মঘণ্টা ও ওভারটাইম নির্ধারণ করার সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।
আবার কিছু সুপারিশ আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে বলে উল্লেখ করেন স্টেকহোল্ডাররা।
গত ২১ এপ্রিল কমিশন সুপাারিশ দেওয়ার পর যে সময় বর্তমান সরকার হাতে পেয়েছে, তাতে আরো অনেক বেশি পরিমাণ সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যেত বলে মনে করেন শ্রম সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমরা যে সুপারিশ করেছি, তা বাস্তবায়নযোগ্য। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাস্তবায়ন হয়নি। যতটুকু হয়েছে, তা আমাদের লেগে থাকা ও ইন্টারন্যাশনাল পুশের কারণে। এর পাশাপাশি শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও প্রচেষ্টা ছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে তা দেশের শ্রম খাতের জন্য একটা মাইলস্টোন হতো।'
'যেসব সুপারিশের বাস্তবায়ন হয়নি বা আংশিক হয়েছে, তার বাস্তবায়ন পরবর্তী সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে' জানিয়ে তিনি বলেন, 'শ্রম অধিকার কর্মীদের চাপ অব্যাহত থাকলে পরবর্তীতে এটি বাস্তবায়নে অগ্রগতি হবে।'
সংশ্লিষ্টরা বলেন, শ্রম সংস্কারের বিষয়টিকে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ থেকে চাপ ও সরকারের সদিচ্ছা।
শ্রম সংস্কারের একটি বড় সুপারিশ ছিল কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়া সহজ করা, যা নিয়ে বিশ্বব্যাপী, বিশেষত আইএলওর সভায় সমালোচনার মুখে পড়তে হতো বাংলাদেশকে।
অতীতে যেকোনো কারখানার ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতির ভিত্তিতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা যেত। নতুন শ্রম আইনের সংশোধনীতে তা ২০ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
একটি কারখানায় সর্বোচ্চ ৫টি পর্যন্ত ইউনিয়ন গঠন করা যাবে। তবে কালেক্টিভ বার্গেইনিং এজেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ উপেক্ষিত হয়েছে।
তবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সরকারের সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়েছে মালিকপক্ষ।
কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হলেও প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক শ্রম মান আসলেই পালিত হচ্ছে কি না সেটি এখন দেখার বিষয়। এই আইনের কার্যকর বাস্তবায়নই এখন সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন শ্রম বিশেষজ্ঞরা।
শ্রম আদালতের সক্ষমতা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হলেও শ্রম আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি বা সার্কিট কোর্ট স্থাপনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
শ্রম পরিদর্শন অধিদপ্তরের শক্তিশালীকরণেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস করা হয়নি, ১২০ দিন করা হয়েছে।
শ্রম শক্তি নিবন্ধন ও তথ্যভান্ডার, ডিজিটাল শ্রম নিবন্ধন ব্যবস্থার; স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও ট্রেনিং প্রোগ্রাম সম্প্রসারণ; অভিবাসী শ্রমিক সুরক্ষা; শ্রম সংস্কার তদারকি ব্যবস্থাপনার সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।
শ্রম আইন সংশোধন অধ্যাদেশে জবরদস্তিমূলক শ্রমকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ করে ধারা ৩৪৮গ যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু জবরদস্তিমূলক শ্রমের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়নি।
দ্রুত শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তি চালু ও শক্তিশালী করার সুপারিশ বাস্তবায়নে কিছু বিষয় আইনে এসেছে।
তবে জীবনী মজুরির ধারণাকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে সর্বজনীন জাতীয় ন্যূনতম মজুরি চালুর বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই হয়নি।
বাংলাদেশ সরকার উল্লিখিত তিনটি আন্তর্জাতিক কনভেনশনই অনুসমর্থন করেছে এবং শ্রম আইনে সেফটি কমিটি গঠন-সংক্রান্ত বিধানও সংশোধন করা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে ৫০ বা তার অধিক শ্রমিক নিয়োজিত থাকলে সেখানে সেফটি কমিটি গঠন ও কার্যকর করতে হবে।
শ্রমিক কল্যাণ তহবিল ও কেন্দ্রীয় তহবিলের জন্য ডিজিটাল আবেদন পদ্ধতি চালু করা এবং তহবিল ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য ত্রিপক্ষীয় নিরীক্ষা ও মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা, কল্যাণ সুবিধার আওতা বৃদ্ধি করে সব খাতের শ্রমিককে অন্তর্ভুক্ত করা এবং শ্রমিকদের পরিবারের জন্য সহায়তার পরিধি বাড়িয়ে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন সংশোধন করা-সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।
