২০২৬ সালে ভারত থেকে ও জিটুজি ভিত্তিতে ১০০ কোটি ডলার জ্বালানি আমদানি করবে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ২০২৬ সালের জন্য একটি বড় জ্বালানি আমদানি পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। এর আওতায় ভারত থেকে আন্তঃসীমান্ত পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রায় ১১৯ মিলিয়ন ডলারের এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সরবরাহকারীদের কাছ থেকে সরকারি (জিটুজি) চুক্তির অধীনে আরও ৮৮২.৩৩ মিলিয়ন ডলারের জ্বালানি তেল কেনা হবে।
গত ১০ ডিসেম্বর বিপিসির ১,০১৪তম বোর্ড সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কর্পোরেশনের সচিব মো. আমিন উল আহসান।
বিপিসি কর্মকর্তাদের মতে, ভারতের নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেডের (এনআরএল) সাথে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির অধীনে ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের মাধ্যমে ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার টন লো-সালফার ডিজেল আমদানি করবে বিপিসি।
এই চুক্তিটি ২০১৭ সালের অক্টোবরে স্বাক্ষরিত ১৫ বছর মেয়াদী একটি সরকারি চুক্তির অংশ, যেখানে আমদানি প্রিমিয়াম প্রতি ব্যারেলে ৫.৫০ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিপিসি কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২ ডিসেম্বর ২০২৫-এর প্ল্যাটস রেফারেন্স মূল্য এবং প্রতি ডলার ১২২.৭০ টাকা বিনিময় হারে পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আমদানির আনুমানিক ব্যয় দাঁড়াবে ১১৯.১৩ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১,৪৬১.৭৬ কোটি টাকা।
তারা জানান, পাইপলাইনের মাধ্যমে এই সরবরাহ উত্তরবঙ্গে ডিজেলের চাহিদা মেটানোর একটি কৌশলগত ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সেচ মৌসুমের ব্যস্ত সময়ে যখন রেল ও সড়ক পরিবহনের ওপর চাপ বাড়ে, তখন এই পাইপলাইন অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে।
ভারত থেকে আমদানির পাশাপাশি বোর্ড ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে জিটুজি চুক্তির অধীনে বিভিন্ন দেশ থেকে ১৩.৮ লাখ টন পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। একই বিনিময় হারে এই ছয় মাসের কর্মসূচিতে আনুমানিক ৮৮২.৩৩ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১০,৮২৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
বোর্ড দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের জন্য অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) আমদানির চুক্তিগুলোও নবায়ন করেছে।
একটি চুক্তির অধীনে বিপিসি ২০২৬ সালে আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি থেকে ৭ লাখ টন 'মুরবান অপরিশোধিত তেল (ক্রুড)' আমদানি করবে। এর মধ্যে ৪ লাখ টন জানুয়ারি-জুন এবং বাকি ৩ লাখ টন জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আসবে। এর দাম নির্ধারণ করা হবে আইসিই ফিউচারস আবুধাবিতে প্রকাশিত আনুষ্ঠানিক বিক্রয় মূল্য অনুযায়ী।
প্রতি ব্যারেল গড় মূল্য ৮৪.২৯ ডলার হিসেবে মুরবান ক্রুড আমদানিতে আনুমানিক ৪৫১.৩৮ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৫,৫৪৩ কোটি টাকা খরচ হবে (বিনিময় হার ১২২.৮০ টাকা ধরে)।
বোর্ড আগামী বছর সৌদি আরামকো থেকে ৮ লাখ টন 'অ্যারাবিয়ান লাইট ক্রুড' আমদানির দীর্ঘদিনের চুক্তিটিও নবায়ন করেছে, যা ২০২৬ সালের দুই অর্ধে সমানভাবে ভাগ করে আনা হবে। এর দাম প্ল্যাটস দুবাই এবং জিএমই ওমানের মাসিক গড়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
প্রতি ব্যারেল গড় ৮৭.৫৩ ডলার দরে এই আমদানির আনুমানিক ব্যয় ৫১৪.৬৮ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৬,৩২০ কোটি টাকা।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড প্ল্যানিং) এ কে এম আজাদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে আমদানির এই পরিকল্পনার কথা নিশ্চিত করে বলেন, অনুমোদিত প্রস্তাবটি ইতোমধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
ভারত থেকে আমদানির বিষয়ে তিনি বলেন, বিপিসির সাথে পাঁচ বছরের একটি চুক্তি রয়েছে যার অধীনে নির্দিষ্ট প্রিমিয়ামে ডিজেল সরবরাহ করা হয়। যদিও এর দাম কিছু বিকল্পের তুলনায় সামান্য বেশি হতে পারে, তবে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি আসায় পরিবহন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কম। তিনি বলেন, 'এটি উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক।'
পাইপলাইন সরবরাহকে সাশ্রয়ী হিসেবে দেখা হচ্ছে
বিপিসি কর্মকর্তারা বোর্ডকে জানান, ২০২৩ সালের মার্চ মাসে চালুর পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন খরচ এবং পরিচালনা—উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধা দিচ্ছে। পাইপলাইন চালুর আগে ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের শুরু পর্যন্ত নুমালীগড় রিফাইনারি থেকে ডিজেল রেলে পরিবহন করা হতো।
এই পাইপলাইনটি ১৩১.৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ, যার মধ্যে প্রায় ৫ কিলোমিটার ভারতে এবং বাকি ১২৬.৫৭ কিলোমিটার বাংলাদেশে। ডিজেল এখন সরাসরি পার্বতীপুর ডিপোতে পৌঁছে যায়, যা উপকূলীয় ডিপো এবং দূরপাল্লার রেল পরিবহনের ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে।
বিপিসির হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রাম থেকে পার্বতীপুরে সমুদ্র ও রেলে ডিজেল পরিবহনে আমদানি প্রিমিয়ামের বাইরে প্রতি ব্যারেলে অতিরিক্ত ২.৬৪ ডলার খরচ হয়। ২০২৬ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ের জন্য সমুদ্রপথে ডিজেল আমদানির প্রিমিয়াম ৫.৩৩ ডলার, ফলে মোট সরবরাহ খরচ দাঁড়ায় ব্যারেলে প্রায় ৭.৯৭ ডলার।
এর তুলনায় পাইপলাইনে আমদানিতে খরচ হয় মাত্র ৫.৫০ ডলারের নির্দিষ্ট প্রিমিয়াম।
কর্মকর্তারা আরও জানান, বিশেষ করে বোরো সেচ মৌসুমে যখন উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ডিজেলের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যায়, তখন রেল ওয়াগনের সংকট দেখা দেয়। পাইপলাইনের সরবরাহ এই সময়ে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২০২৬ সালের জন্য বিপিসি এনআরএল থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টন ০.০০৫ শতাংশ সালফার যুক্ত ডিজেল আমদানির পরিকল্পনা করেছে (পরিমাণ ১০ শতাংশ কম-বেশি হতে পারে)।
বছরের প্রতি অর্ধে ৬০ হাজার টন করে নিশ্চিতভাবে আমদানি করা হবে এবং অতিরিক্ত ৩০ হাজার টন ঐচ্ছিক হিসেবে রাখা হবে।
২০২৫ সালের ২ ডিসেম্বর বিপিসির প্রিমিয়াম নেগোশিয়েশন কমিটি এবং নুমালীগড় রিফাইনারির মধ্যে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকের পর এই পরিমাণ চূড়ান্ত করা হয়। সেখানে ভারতীয় শোধনাগারটি বিদ্যমান মূল্যের কাঠামোতেই ডিজেল সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে।
জ্বালানির প্রকৃত দাম সরবরাহের সময়কালের গড় প্ল্যাটস মূল্যের সাথে নির্দিষ্ট প্রিমিয়াম যোগ করে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে হিসাব করা হবে। বিনিময় হারের ওঠানামা এবং বৈশ্বিক দামের পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত খরচ নির্ধারিত হবে।
পরিশোধিত জ্বালানি আমদানিতে ডিজেলের প্রাধান্য
২০২৬ সালের প্রথমার্ধে পরিশোধিত জ্বালানি আমদানির বড় অংশ জুড়ে থাকবে ডিজেল। পরিবহন, কৃষি, সেচ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ডিজেলের ব্যাপক চাহিদাই এর কারণ।
অনুমোদিত ১৩.৮ লাখ টনের মধ্যে বিপিসি ৮.৯ লাখ টন লো-সালফার ডিজেল আমদানি করবে, যা মোট আমদানির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এই কর্মসূচিতে ১.৮৫ লাখ টন জেট এ-১ ফুয়েল, ১ লাখ টন ৯৫-অক্টেন পেট্রোল, ১.৭৫ লাখ টন ফার্নেস অয়েল এবং ৩০ হাজার টন লো-সালফার মেরিন ফুয়েল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
শিপমেন্ট এবং চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধি সামলাতে প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রেই ১০ শতাংশ কম-বেশি হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
গত নভেম্বরের শেষের দিকে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় আলোচনা এবং অনলাইন বৈঠকের পর জিটুজি আমদানির জন্য সাতটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হয়েছে। এগুলো হলো চীনের পেট্রোচায়না ও ইউনিপেক, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইএনওসি, ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, ওমানের ওকিউ ট্রেডিং, মালয়েশিয়ার পিটিএলসিএল এবং ইন্দোনেশিয়ার বিএসপি।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবারের প্রিমিয়াম আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ডিজেলের প্রিমিয়াম প্রতি ব্যারেলে ৫.৩৩ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ছিল ৮.৭৫ ডলার। এ ছাড়া জেট এ-১ এর জন্য ৬.৫০ ডলার, অক্টেনের জন্য ৬.৮০ ডলার, ফার্নেস অয়েলের জন্য প্রতি টন ৫৩ ডলার এবং মেরিন ফুয়েলের জন্য ৭৯.৫০ ডলার প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা হয়েছে।
বর্তমান রেফারেন্স মূল্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ডিজেল আমদানিতে খরচ হতে পারে প্রায় ৫৮৭.৯ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া জেট এ-১, অক্টেন, ফার্নেস অয়েল এবং মেরিন ফুয়েল আমদানিতে যথাক্রমে ১৩৫.৯ মিলিয়ন, ৭৩.৮ মিলিয়ন, ৬৯.৬ মিলিয়ন এবং ১৫.১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বোর্ড সদস্যরা উল্লেখ করেছেন, ক্রমবর্ধমান জাহাজ ভাড়া ও বিমা খরচ, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের মতো জ্বালানি আমদানিকারক অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
বিপিসি জানিয়েছে, এই আমদানি কর্মসূচির অর্থায়ন করা হবে বাজেটের বরাদ্দ, জ্বালানি বিক্রির রাজস্ব, প্রয়োজনে সরকারি সহায়তা এবং বিদেশি অর্থায়ন সুবিধার (যেমন অপরিশোধিত তেল আমদানির জন্য আইটিএফসি-এর অর্থায়ন) মাধ্যমে।
অনুমোদিত সব প্রস্তাব এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পেশ করা হবে। এরপর ২০২৬ সালজুড়ে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চুক্তি সম্পাদনের কাজ শুরু করবে বিপিসি।
