প্লট বরাদ্দে দুর্নীতি: পৃথক ৩ মামলায় হাসিনার ২১, জয় ও পুতুলের ৫ বছরের কারাদণ্ড
ঢাকার পূর্বাচলের নতুন শহর প্রকল্পে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির পৃথক তিন মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাত বছর করে মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। পাশাপাশি ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ১৮ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে তাকে।
এদিকে, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫ বছরের কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। এছাড়াও, তাকে এক লাখ টাকার অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ৫ বছরের কারদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া, এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
আজ বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) বেলা ১১টা ২৪ মিনিটে রায় পড়া শুরু করেন ঢাকার বিশেষ জজ-৫-এর বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালত। দুপুর ১২ টা ৫ মিনিটে রায় পড়া শেষ হয়। রায় ঘোষণার সময় পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, 'সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে নিয়মানুযায়ী প্লট বরাদ্দের কোন আবেদন না করলেও প্লটের দখল বুঝে পেতে ঠিকই আবেদন করেছিলেন। এতে বোঝা যায় যে, শেখ হাসিনার সম্পদের প্রতি লোভ ছিল।'
পৃথক তিন মামলায় কারাগারে থাকা একমাত্র আসামি রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে আদালতে হাজির করা হয়। শুরু থেকে শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল পলাতক রয়েছেন। শেখ হাসিনা তিন মামলার আসামি। জয় ও পুতুল পৃথক এক মামলার আসামি।
মামলায় আরও ১৮ জনের যে সাজা হয়েছে
শেখ হাসিনার সাবেক একান্ত সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনের ২ মামলায় ৬ বছর করে মোট ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। এক লাখ টাকা করে মোট ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও ৬ মাস করে এক বছরের কারাদণ্ড।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের ৩ মামলায় ৬ বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, এক লাখ টাকা করে মোট ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ৬ মাস করে দেড় বছরের কারাদণ্ড।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার- ৩ মামলায় ৬ বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, এক লাখ টাকা করে মোট ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াছি উদ্দিন- ৩ মামলায় ৬ বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, এক লাখ টাকা করে মোট ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ৬ মাস করে দেড় বছরের কারাদণ্ড।
সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদারের ৩ মামলায় ১ বছর করে মোট ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, পাঁচ, দশ ও পাঁচ হাজার টাকা করে মোট ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ১ মাস করে ৩ মাসের কারাদণ্ড।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা- ৩ মামলায় ৫ বছর করে মোট ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, পঞ্চাশ হাজার টাকা করে মোট দেড় লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ৩ মাস করে ৯ মাসের কারাদণ্ড।
রাজউকের সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনের ৩ মামলায় ৩ বছর করে মোট ৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, ২০ হাজার টাকা করে মোট ষাট হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ২ মাস করে ৬ মাসের কারাদণ্ড।
সাবেক মেজর (ইঞ্জিনিয়ার) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরীর (অব.) ৩ মামলায় ৩ বছর করে মোট ৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, ২০ হাজার টাকা করে মোট ষাট হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ২ মাস করে ৬ মাসের কারাদণ্ড।
রাজউকের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কবির আল আসাদের এক মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও দুই মাস কারাদণ্ড।
রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাসের ২ মামলায় ৩ বছর করে মোট ৬ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ২ মাস করে ৪ মাসের কারাদণ্ড।
রাজউকের সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মো. নুরুল ইসলামের ২ মামলায় ৩ বছর করে মোট ৬ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ২ মাস করে ৪ মাসের কারাদণ্ড।
রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) শেখ শাহিনুল ইসলামের এক মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও দুই মাস কারাদণ্ড।
রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) মো: কামরুল ইসলামের এক মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও দুই মাস কারাদণ্ড।
রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) মো. হাফিজুর রহমানের এক মামলায় ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও এক মাস কারাদণ্ড।
রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) মো: হাবিবুর রহমান সবুজের এক মামলায় ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও এক মাস কারাদণ্ড।
রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) নায়েব আলী শরীফের ২ মামলায় ১ বছর করে মোট ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, ৫ হাজার টাকা করে মোট ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ১ মাস করে ২ মাসের কারাদণ্ড।
রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) মাজহারুল ইসলামের এক মামলায় ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও এক মাস কারাদণ্ড।
রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের ৩ মামলায় ১ বছর করে মোট ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি, ৫ হাজার টাকা করে মোট ১৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ১ মাস করে ৩ মাসের কারাদণ্ড।
এদিকে, অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম সরকারকে তিন মামলায় বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।
আসামিদের মধ্যে একমাত্র আসামি খুরশীদ আলম কারাগারে রয়েছে। রায় ঘোষণার সময় তাকে আদালতে হাজির করা হয়। রায় শেষে সাজা পরোয়ানা দিয়ে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হয়। অপর আসামিরা পলাতক থাকায় আদালত তাদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানাসহ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
রায় শেষে দুদক প্রসিকিউটর খান মো. মাইনুল হাসান লিপন বলেন, 'আমরা আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু তা হয়নি। কমিশনের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
অন্যদিকে, খুরশীদ আলমের আইনজীবী শাহীনুর ইসলাম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এদিকে, রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। দায়রা আদালতের প্রবেশমুখে বসানো হয় পুলিশের চেকপোস্ট। এছাড়াও, নিরাপত্তার জন্য বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের ডিসি মিয়া মোহাম্মদ আশিস বিন হাছান বলেন, 'আমাদের নিয়মিত সদস্যের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরও ২ প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। দুই প্লাটুন বিজিবির সদস্য দায়িত্বে আছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'এছাড়া লোকাল থানার পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা চত্বরে টহলরত আছে। এখনো পর্যন্ত নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। আমরা সতর্ক আছি।'
উল্লেখ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার সরকারি প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে গত ১৪ জানুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আটজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক সালাহউদ্দিন। তদন্ত শেষে গত ১০ মার্চ ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া। এই মামলায় ২৯ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন।
শেখ হাসিনা ছাড়াও মামলায় অপর আসামিরা হলেন— জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব পুরবী গোলদার, রাজউক-এর সাবেক চেয়ারম্যানের পিএ মো. আনিছুর রহমান মিঞা, রাজউক-এর সাবেক সদস্য শফি উল হক, খুরশীদ আলম, মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, মেজর (ইঞ্জি.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (অব.), উপ-পরিচালক নায়েব আলী শরীফ, জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম সরকার, সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, সচিব শহিদ উল্লাহ খন্দকার এবং সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ।
অপরদিকে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার সরকারি প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে ১৪ জানুয়ারি সজীব ওয়াজেদ জয় ও শেখ হাসিনাসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মামলাটি করেন দুদকের সহকারী পরিচালক এস এম রাশেদুল হাসান। তদন্ত শেষে গত ১০ মার্চ আরো দু'জনসহ মোট ১৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের সহকারি পরিচালক এস এম রাশেদুল হাসান। এ মামলায় আদালতে ২৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
গত ৩১ জুলাই ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন এই তিন মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
