পুনরায় চালুর সরকারি উদ্যোগ উপেক্ষা করে বেক্সিমকোর ৬ কারখানা নিলামে তুলছে জনতা ব্যাংক
পুনরায় চালুর সরকারি উদ্যোগে সাড়া না দিয়ে বেক্সিমকো লিমিটেডের ছয়টি কারখানা নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক লিমিটেড।
গত ২০ নভেম্বর পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার দু'দিনের মধ্যে ব্যাংকটি বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের তিন কারখানার জামানত হিসেবে দেওয়া ১৯৩ শতাংশ জমি এবং তার ওপর থাকা সব স্থাপনার নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
আরও তিন কারখানার নিলাম বিজ্ঞপ্তি শিগগিরই প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে।
গত ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জনতা ব্যাংকের বোর্ড সভাটি প্রথমে ১৮ নভেম্বর তারিখে আয়োজন করা হয়েছিল। ওইদিনের সভার এজেন্ডায় ছিল বেক্সিমকোর সম্পদ নিলামে তোলার বদলে, বেক্সিমকো লিজ নিতে আগ্রহী জাপানি প্রতিষ্ঠান রিভাইভাল এবং জনতা ব্যাংকের মধ্যে চুক্তির খসড়া অনুমোদন। তবে সভা স্থগিত করে এজেন্ডায় পরিবর্তন আনা হয় এবং নতুন এজেন্ডা হিসেবে বেক্সিমকো লিমিটেডের ঋণ আদায়ে বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে তোলার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই বিষয়ে মতামত জানতে জনতা ব্যাংকের এমডি ও সিইও মো. মজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে ফোন রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ করে ফোন দিলে তিনি তা রিসিভ করেন। নিলামে তোলার কারণ জানতে চাইলে তিনি মিটিংয়ে আছেন জানিয়ে পরে কথা বলবেন বলে ফোন কেটে দেন। এরপর তিনি আর ফোন ধরেননি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ২১ নভেম্বর কয়েকটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জনতা ব্যাংক বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেল লিমিটেডের ইউনিট–১ ও ইউনিট–২, আরবান ফ্যাশনস লিমিটেড এবং অ্যাপোলো অ্যাপারেলস লিমিটেডের ঋণ ও সুদসহ পাওনা আদায়ে নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। আগ্রহী ক্রেতাদের আগামী ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দরপত্র জমা দেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয়েছে।
যা আছে নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেল লিমিটেডের ইউনিট–১ ও ইউনিট–২–এ জনতা ব্যাংক ৫৪৩.৭০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল, যা সুদ-আসলে দাঁড়িয়েছে ১,৭৫৪.৭০ কোটি টাকায়।
আরবান ফ্যাশনস লিমিটেডে ২৫২.৪৫ কোটি টাকার ঋণ সুদ-আসলে বেড়ে হয়েছে ৭২৪.২৬ কোটি টাকা। অ্যাপোলো অ্যাপারেলস লিমিটেডকে দেওয়া ২৫১.২৬ কোটি টাকার ঋণ সুদ-আসলে দাঁড়িয়েছে ৮১৬.৪০ কোটি টাকায়।
সব মিলিয়ে ৩,২৯৫ কোটি টাকা আদায়ের জন্য এই তিন কারখানার সব মেশিনপত্র, মজুদ মালামাল, গাজীপুরের কাশিমপুরে অবস্থিত বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের পাশের ১৯৩ শতাংশ জমি এবং সেখানে নির্মিত ও নির্মাণাধীন স্থাপনা নিলামে তোলা হয়েছে।
এর পাশাপাশি ক্রিসেন্ট ফ্যাশনস অ্যান্ড ডিজাইন লিমিটেডের কাছে পাওনা ১,৩৯৭ কোটি টাকা, অ্যাসেস ফ্যাশন লিমিটেডের কাছে পাওনা ১,১৩৫ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের কাছে পাওনা ১,৩১৬ কোটি টাকা আদায়েও এসব প্রতিষ্ঠানের জমাকৃত স্থাবর সম্পত্তি নিলামে তোলা হবে।
কারখানা পুনরায় চালুর সরকারি উদ্যোগ
এদিকে, হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান ও রপ্তানি আয় ধরে রাখতে বেক্সিমকো লিমিটেডের আন্তর্জাতিক মানের টেক্সটাইল কারখানাগুলো পুনরায় চালু করতে দীর্ঘদিন ধরেই উদ্যোগ নিচ্ছে শ্রম মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, জনতা ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাংককে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে একাধিক বৈঠক করেছে মন্ত্রণালয়।
গত মে মাসে বেক্সিমকোর কারখানাগুলো লিজ ভিত্তিতে চালুর প্রস্তাব দিয়ে সরকারের কাছে আগ্রহপত্র (ইওআই) দাখিল করে জাপানি কোম্পানি রিভাইভাল প্রজেক্ট লিমিটেড। বেক্সিমকো লিমিটেডও এর বিপরীতে সরকারের কাছে লেটার অব কমফোর্ট জমা দেয়।
এরপর থেকেই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কারখানাগুলো চালুর প্রক্রিয়া শুরু করে। ২২ জুলাই অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংককে নিয়ে প্রথম বৈঠক করে শ্রম মন্ত্রণালয়। পরবর্তী কয়েক দফা বৈঠকেও ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায় থেকে বেক্সিমকোর কারখানাগুলো চালুর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সম্মত হয়।
২০২৪ সালের নভেম্বরে গঠিত ১১ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিও বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রম ও ব্যবসা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এবং রিভাইভালের প্রস্তাব বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেয়। এই কমিটির আহ্বায়ক শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
এর পাশাপাশি গত ৩০ জুন গঠিত ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, বন্দর ও রাজস্ব আদায় কার্যক্রম গতিশীলকরণে পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিও বেক্সিমকোর কারখানা পুনরায় চালুর পক্ষে মতামত দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকও এ বিষয়ে কয়েকটি বৈঠক করেছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে মত দেওয়া হয়েছে যে, বেক্সিমকো তার কারখানাগুলো লিজ দিতে পারবে।
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রিভাইভাল বেক্সিমকো লিমিটেডের কারখানাগুলো লিজ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাপানি প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিকভাবে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বিনিয়োগের কথা জানিয়েছে, পরবর্তীতে বিনিয়োগ ১০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনাও জানিয়েছে।
রিভাইভালের উদ্যোগে অর্থায়ন করবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইকোমিলি। বেক্সিমকোর বিদেশি বায়াররাও কারখানা চালুর অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খসড়া চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে—রিভাইভাল কারখানাগুলো পরিচালনা করে রপ্তানি আয়ের ১.৫ শতাংশ থেকে ২.৫ শতাংশ কমিশন নেবে। পরিচালন ব্যয় বাদে বাকি সব অর্থ দিয়ে জনতা ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা হবে। এই আয়ের কোনো অংশ বেক্সিমকো নিতে পারবে না।
জানা গেছে, এই লিজ প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল। গত ৮ অক্টোবর রিভাইভাল, বেক্সিমকো গ্রুপ ও জনতা ব্যাংকের মধ্যে আলোচনায় চুক্তির একটি খসড়া তৈরি হয়। এই খসড়াটি অনুমোদনের জন্য ১৮ নভেম্বরের বোর্ড সভার এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু সভা স্থগিত করে সেটি ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় এবং এজেন্ডা পরিবর্তন করে বেক্সিমকোর কারখানা ও জামানত হিসেবে থাকা স্থাবর সম্পত্তি নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
