ঢাকায় বারবার ভূমিকম্প: উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় নগরবাসী
শুক্রবারের (২১ নভেম্বর) ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ১০ জনের প্রাণহানি ও অন্তুত ৪৬০ জন মানুষ আহত হওয়ার পরদিন শনিবার দুপুর ও সন্ধ্যায় রাজধানীতে তিন দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। যদিও নতুন এসব ভূমিকম্পে কোনো হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, তবুও নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
শনিবার সকালে ৩.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের পর সন্ধ্যায় এক সেকেন্ডের ব্যবধানে হওয়া দু'দফা ভূমিকম্পকে 'আফটারশক' উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বড় ধরনের ভূমিকম্পের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সাধারণত তীব্রতা কমে আফটারশক অনুভূত হতে পারে। শনিবারের ভূকম্পগুলোও সেই ধারাবাহিকতার অংশ বলে জানান তারা এবং নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) পরিচালক (বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. মোমেনুল ইসলাম বলেন, "গতকাল যে ৫.৭ মাত্রার বড় ভূমিকম্প হয়েছে, আজকের দুটি ভূমিকম্প সেই ঘটনার আফটারশক। সাধারণত আফটারশকের মাত্রা আগের ভূমিকম্পের তুলনায় অন্তত ১ পয়েন্ট কম থাকে। তাই ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এমন ঘটনা স্বাভাবিক। আতঙ্কিত না হয়ে শকের সময় নিরাপদে থাকা গুরুত্বপূর্ণ।"
তিনি আরও বলেন, "গতকাল ভূমিকম্পের মাত্রা ৬ এর নিচে হলেও কম্পন কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী ছিল এবং ঝাঁকিও বেশি লেগেছে। এর কারণ আমাদের অঞ্চলের মাটির গঠন তুলনামূলক দুর্বল। মাটি দুর্বল হলে ভূকম্পের স্থায়িত্বও বাড়ে।"
এদিকে, পরপর দু'দিনে চার দফা ভূমিকম্পে পুরান ঢাকা ও বংশালের মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কারণে অনেকে নিরাপদ স্থানের খোঁজ করছেন।
বংশালের গৃহিণী সায়মা বেগম টিবিএসকে বলেন, "ভূমিকম্প শুরু হতেই আমরা বাচ্চাদের নিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে যাই। শরীর কাঁপছিল। এই এলাকায় সব ভবন একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো, কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। নামলেও বাঁচার উপায় নেই এমন অবস্থা। ভয় পাই—যদি বড় ভূমিকম্প পুরান ঢাকায় হয়, তাহলে এখানে শুধু লাশই দেখা যাবে। কেউ জানে না কী হবে, শুধু দোয়া করছি।"
পুরান ঢাকার আরেক বাসিন্দা জহির বলেন, "ফেসবুকে দেখছি আবার ভূমিকম্প হতে পারে। খুব চিন্তায় আছি। আল্লাহ না করুক ঘুমের মধ্যেই যদি কিছু হয়ে যায়! ভাবছি এখানে থাকা ঠিক হবে কিনা। পরিবার আর বাচ্চাদের কথা ভেবেই মনটা বেশি অস্থির লাগছে।"
চকবাজারের ব্যবসায়ী আরাফাত বলেন, "গতকালের ভূমিকম্পে খুব ভয় পেয়ে যাই। দৌড়ে নিচে নেমে গিয়েছিলাম। সবকিছু কাঁপছিল। আজকের কম্পনগুলো দেখে আরও ভয় লাগছে—যদি আবার হয়। এখানকার ভবনগুলো সবই পুরনো, যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। সত্যি বলতে কেউ জানে না কী হবে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এম সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "বাংলাদেশের উত্তরে ইউরেশিয়ান প্লেট, দক্ষিণে ইন্ডিয়া প্লেট এবং পূর্বে বার্মিজ সাবপ্লেট অবস্থান করছে। এই ত্রিমুখী প্লেটের গতিশীলতার কারণেই ভূমিকম্প হয়। অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে আগামী বহু বছর ধরে বিভিন্ন মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. বদরুদ্দোজা মিয়া টিবিএসকে বলেন, "ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। কারণ বাংলাদেশ ইউরেশিয়ান ও ইন্ডিয়া প্লেট এবং বার্মিজ সাবপ্লেট—এই তিনটি শক্তিশালী গতিশীল বেসিনের সম্মিলিত প্রভাবে গঠিত একটি ডেল্টা অঞ্চল। ফলে রিখটার স্কেলের ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প এখানে স্বাভাবিক।"
তিনি বলেন, "২১ নভেম্বরের ভূমিকম্প যদি 'মেইন শক' হয়ে থাকে, তবে ২২ নভেম্বরের ভূমিকম্প 'আফটারশক'। এমন আফটারশক আরও কয়েক দিন চলতে পারে। আর ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্প যদি 'ফোরশক' হয়, তাহলে সামনে বড় ধরনের মেইন শক আসতে পারে। এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ ঝুঁকি মোকাবেলায় সব পর্যায়ে প্রস্তুতি নিতে হবে।"
এদিকে, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় ইমার্জেন্সি রেসপন্স সেল গঠন এবং আর্থিক সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এই সেল গঠন করেছে। ০২৫৮৮১১৬৫১ নম্বরে কল করলে দ্রুত সাড়া পাওয়া যাবে বলে জানা গেছে।
ভূমিকম্পে নিহতদের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা এবং আহতদের ১৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী এবং মাগুরার জেলা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা অব্যাহত রেখেছে।
রাজউকও পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন করেছে। আরমানিটোলা, মুগদা এবং বাড্ডার আলাতুন্নেসা স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বেশ কিছু স্থাপনা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। যেসব ভবনে দৃশ্যমান ফাটল রয়েছে, সেসব ভবনের নকশা সাত দিনের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ কিছু অংশ তাৎক্ষণিকভাবে অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জননিরাপত্তার জন্য আশপাশের দোকানপাট ও ফুটপাতের দোকান সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, "এই ভূমিকম্প আমাদের জন্য এক সতর্কবার্তা। এই বার্তা অবহেলা করলে বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ কাঠামো চিহ্নিত করে সেগুলো সিল বা অপসারণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যৎ বিপর্যয় ঠেকাতে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।"
তঙ্ক নয়, প্রস্তুতির ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা
ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় খোলা মাঠের ব্যবস্থা করা, নির্মাণ বিধিমালা মেনে ভবন নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এম সাইফুল ইসলাম বলেন, "এই ভূমিকম্প ঠেকানো যাবে না। ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য রাষ্ট্রীয়, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থেকে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত সবাইকে উদ্যোগ নিতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে প্রস্তুতি নেওয়াই গুরুত্বপূর্ণ।"
প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবারের ভূমিকম্পে ঢাকায় ৪ জনের মৃত্যু ও ৫৯ জন আহত হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে ১ জনের মৃত্যু ও ১৮ জন আহত, নরসিংদীতে ৫ জনের মৃত্যু ও ১১০ জন আহত, গাজীপুরে ২৫২ জন আহত এবং মাগুরায় আহত হয়েছেন ২২ জন।
