দেশে প্রথমবারের মতো একই জমিতে আর্টিমিয়া ও লবণ চাষের সমন্বিত পদ্ধতি উদ্ভাবন
দেশে প্রথমবারের মতো একই জমিতে আর্টিমিয়া ও লবণ উৎপাদনের সমন্বিত পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক। এই পদ্ধতিটি দীর্ঘদিনের প্রচলিত আলাদা চাষের ধারা বদলে দ্বৈত উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা দেশের মৎস্য ও লবণ শিল্পে সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে।
মাছ ও চিংড়ির হ্যাচারিতে আর্টিমিয়া বহুদিন ধরে উচ্চমানের জীবন্ত খাবার (লাইভ ফিড) হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লবণাক্ত পানি ও লবণ হ্রদে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা এ ক্ষুদ্র শৈবালভোজী প্রাণীর শুকনো ডিম বা 'সিস্ট' বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে আমদানি-রপ্তানি হয়। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন সামুদ্রিক হ্যাচারিতে আর্টিমিয়ার ব্যবহার বেড়েছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে ৪০-৫০ টন আর্টিমিয়া আমদানি করা হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। নতুন এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো গেলে দেশের অর্থ দেশেই রাখা যাবে বলে মনে করছন গবেষকরা।
নতুন উদ্ভাবিত এই পদ্ধতির মাধ্যমে একইসঙ্গে লবণ ও আর্টিমিয়া চাষ করা সম্ভব হবে। এর ফলে ব্যয় কমবে, আয় বাড়বে এবং সার্বিকভাবে চাষ ব্যবস্থা আরও সাশ্রয়ী ও টেকসই হবে। পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত আর্টিমিয়া রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও বাড়বে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কারিগরি জ্ঞান দ্রুত কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে গবেষকরা উদ্যোক্তাদের এই খাতে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, পর্যাপ্ত প্রণোদনা, প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো ও নীতি সহায়তা পেলে এই সমন্বিত আর্টিমিয়া-লবণ চাষ পদ্ধতি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং রপ্তানিমুখী সম্ভাবনা বাড়বে।
কক্সবাজার সদর উপজেলার চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের বটতলা এলাকার একটি উঁচু ও সমতল লবণ মাঠে এই পদ্ধতির মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। জায়গাটির স্বভাব-অনুকূল পরিবেশ শুষ্ক মৌসুমে আর্টিমিয়া চাষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রকল্পের অংশ হিসেবে 'মাঠ পর্যায়ে আর্টিমিয়া ও লবণের সমন্বিত চাষ সহায়িকা' নামে একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে আর্টিমিয়া চাষ পদ্ধতি, পুকুর প্রস্তুতি, খাবার ব্যবস্থাপনা, বায়োমাস ও সিস্ট সংগ্রহ, লবণ আহরণ, ফ্লেক ফিড প্রস্তুত, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপণন বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের সাস্টেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট-এর (এসসিএমএফপি) অর্থায়নে ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পটি শুরু হয়। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে মাঠ পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। গবেষণার সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন চবির ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেসের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম। দলে আরও ছিলেন অধ্যাপক আয়শা আক্তার, সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ মুস্তফা মনোয়ার, সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ নেছারুল হক, প্রভাষক মিঠু রঞ্জন সরকার ও আলম পারভেজ। এছাড়া ১০ জন গবেষণা সহকারী এতে অবদান রাখেন।
ড. শফিকুল ইসলাম জানান, গবেষক দলটি পরবর্তীতে অক্টোবরে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করে। তিনি মনে করেন, দেশের প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলজুড়ে এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের সুনীল অর্থনীতি এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'এখন প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করা, যাতে উৎপাদিত আর্টিমিয়া, সিস্ট, বায়োমাস ও লবণ বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা যায়। সরকারি প্রণোদনা পেলে বাংলাদেশেও এটি সম্ভাবনাময় শিল্পে পরিণত হবে।'
গবেষক আলম পারভেজ বলেন, আর্টিমিয়া ও লবণের সমন্বিত চাষ পদ্ধতি উপকূলীয় অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকদের পাশাপাশি নারীদেরও আয়ের অন্যতম উৎস হতে পারে। কারণ জীবন্ত প্রোটিন হিসেবে হ্যাচারিগুলোতে আর্টিমিয়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
গবেষণা সহকারী মার্সি মিনাক্ষী ম্রং বলেন, পানির সঠিক লবণাক্ততা, তাপমাত্রা ও ফিড ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে স্থানীয়ভাবেই উচ্চমানের আর্টিমিয়া উৎপাদন সম্ভব। এতে আমদানিনির্ভরতা ও হ্যাচারির খরচ কমবে।
গবেষণা সহকারী তাসনিম আক্তার ও এশা সালবিন বলেন, সমন্বিত চাষের ফলে লবণের মান এবং চাষিদের আয়—উভয়ই বাড়তে পারে। কারণ আর্টিমিয়া পানির গুণমান উন্নত করে এবং লবণ মাঠে পানি প্রবেশ করানোর সময় আর্টিমিয়া থাকায় উৎপাদিত লবণ আরও পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ হয়।
