তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল
বহুল আলোচিত নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করা হয়েছে। আপিলে পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটাই বাতিলের আবেদন জানানো হয়েছে।
সোমবার (৩ নভেম্বর) রিটকারী সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের পক্ষে আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া এ আপিল দায়ের করেন।
আপিল দায়েরের পর ড. শরীফ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, "হাইকোর্টের রিটে আমরা পঞ্চদশ সংশোধনী পুরোটাই বাতিল চেয়েছিলাম। কিন্তু হাইকোর্ট রায়ে কয়েকটি বিধান বাতিল করে। এর ফলে অনেকগুলো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ওই সংশোধনীর মূল বিষয় ছিল কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা। ওই সংশোধনীতে সংবিধানের ২২ ও ২১ অনুচ্ছেদ দিয়ে ৫৮ (গ) অনুচ্ছেদ বাতিল করে। কিন্তু এই অনুচ্ছেদগুলো বাতিল হলেও আরও অনেকগুলো অনুচ্ছেদ রয়েছে, যেগুলো কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার বিধানের সাথে অসংগতিপূর্ণ রয়ে গেছে। কেয়ারটেকার সরকার পুরোপুরি কার্যকর করতে হলে, অসংগতিগুলোর সুরাহা করতে হবে, এজন্য পঞ্চদশ সংশোধনী পুরো বাতিল করার জন্য আপিল করা হয়েছে।"
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট এক রায়ে বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা করেন। একইসঙ্গে সংবিধানে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনেন উচ্চ আদালত। তবে এই রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনী পুরোটা বাতিল করা হয়নি।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, "গণতন্ত্র হচ্ছে আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। এই গণতন্ত্র বিকশিত হয় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার কোনো প্রতিফলন হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের আত্মবিশ্বাস জনগণের মধ্যে জন্ম নেয়নি। যার ফলশ্রুতিতে হয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান।"
রায়ে হাইকোর্ট আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশে পরিণত হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায়ে বলেন, অনুচ্ছেদ দুটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে, যেটি হচ্ছে গণতন্ত্র।
রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত হওয়া ৭(ক), ৭(খ) এবং ৪৪(২) অনুচ্ছেদকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। ৭(ক) অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ ইত্যাদি অপরাধ এবং ৭(খ) অনুচ্ছেদে সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করার কথা বলা ছিল। অপরদিকে, ৪৪(২) অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার বিষয়ে সংসদকে অন্য কোনো আদালতকে ক্ষমতা দেওয়ার বিধান ছিল, যা বাতিল করা হয়।
গণভোটের বিষয়ে রায়ে বলা হয়, গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করা হয়, যেটি সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অংশ ছিল। এ বিধান বিলুপ্তি সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হলো। ফলে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হলো।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল। রায়ে আদালত বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে (যেমন- জাতির পিতার স্বীকৃতির বিষয়, ২৬ মার্চের ভাষণের বিষয়গুলো) আগামী জাতীয় সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে।
