৩,০৬৩ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ১৫ বছরের পুনঃতফসিল চায় সাইফ পাওয়ারটেক
বন্দর পরিচালনা, জ্বালানি ও শিপিং খাতে সুপরিচিত সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের বর্তমানে ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট ৩,০৬৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এসব ঋণ ১৫ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের আবেদন জানিয়েছে।
কোম্পানির আবেদনের নথি দেখেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। তাতে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে সুদ ও আসল উভয় পরিশোধের ক্ষেত্রে তিন বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছরের পুনঃতফসিল সুবিধা চায়।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি প্রস্তাব করেছে, ব্যাংকের তহবিল সংগ্রহ ব্যয়ের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ যোগ করে সুদের হার নির্ধারণ করা হোক। একই সঙ্গে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন ঋণ সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেন 'কমপ্রোমাইজ অ্যামাউন্ট' পরিশোধের শর্ত আরোপ না করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটি আরও অনুরোধ জানিয়েছে, প্রস্তাবিত সুবিধা প্রদানে যদি একক ঋণগ্রহীতা বা বৃহৎ ঋণ এক্সপোজার সীমা কোনো বাধা সৃষ্টি করে, তবে তা বিশেষ বিবেচনায় শিথিল করার ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
এ বিষয়ে কোম্পানির সেক্রেটারি এফ. মো. সালেহীন টিবিএসকে বলেন, "আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করত। কিন্তু হঠাৎ করেই ব্যাংকগুলো একসঙ্গে পুরো ঋণ পরিশোধের চাপ সৃষ্টি করে। কিছু ব্যাংক আমাদের ঋণ ক্লাসিফাই করে দিয়েছে। হঠাৎ পুরো ঋণ দাবি করা হলে কোনো প্রতিষ্ঠানই তা পরিশোধ করতে পারে না। এজন্যই আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পুনঃতফসিলের সুযোগ চেয়েছি।"
সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের প্রতিষ্ঠানগুলো কেন এই অবস্থায় পড়েছে— জানতে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তারাফদার মো. রুহুল আমিনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো আবেদনে এমডি রুহুল আমিন জানিয়েছেন, তাদের কোম্পানিগুলোর ঋণ শ্রেণিকরণ করায় গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যবসা সচল রাখতে চলতি মূলধন থেকে অর্থ নিয়ে শ্রেণিকৃত ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে; এর ফলে আর্থিক সক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
'এভাবে চলতে থাকলে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো অচল হয়ে পড়বে এবং গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৪,০০০-এর বেশি কর্মী চাকরি হারিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবে,' উল্লেখ করেন আবেদনে।
আবেদনের ব্যাপারে পদক্ষেপ নির্ভর করছে ব্যাংকগুলোর ওপর
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ পুনর্গঠনের সাম্প্রতিক নীতির সঙ্গে সাইফ পাওয়ারটেকের ১৫ বছরের পরিশোধ মেয়াদ ও ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের প্রস্তাবটি সাংঘর্ষিক।
নীতিমালা অনুযায়ী, ৩০০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কমিটির অনুমোদনে করা যাবে। তবে তাতে স্পষ্টভাবে বলা আছে— কোনো গ্রাহকের ঋণ সর্বোচ্চ ১০ বছরের বেশি সময়ের জন্য পুনঃতফসিল করা যাবে না এবং ডাউন পেমেন্ট সর্বনিম্ন ২ শতাংশ হতে হবে। এই সুবিধা ব্যবসায়ীরা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত নিতে পারবেন।
এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের 'ঋণ পুনঃতফসিলের মাস্টার সার্কুলার'-এ সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল এবং ২.৫ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত ডাউন পেমেন্টের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, সাইফ পাওয়ারটেকের পুনঃতফসিলের আবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পৌঁছেছে, তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, "এর আগেও কোম্পানিটি নীতিগত ছাড় চেয়েছিল। আমাদের কমিটি কিছু সুবিধা প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু তারা তা গ্রহণ করেনি।"
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, "এবার পুরো বিষয়টি আমরা ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছি, কারণ তারাই তাদের গ্রাহক সম্পর্কে ভালো জানে। ব্যাংকগুলো পদক্ষেপ নেওয়ার পর আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করব।"
সাইফ পাওয়ারটেকের ৩,০৬৩ কোটি টাকা ঋণ
সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের চারটি প্রতিষ্ঠানের— সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড, ই-ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, সাইফ পোর্ট হোল্ডিং লিমিটেড এবং ম্যাক্সন পাওয়ার লিমিটেড— বর্তমানে ১১টি ব্যাংকে মোট ৩,০৬৩ কোটি টাকার শ্রেণিকৃত ঋণ (ক্লাসিফায়েড লোন) রয়েছে।
এরমধ্যে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে ৭৯০ কোটি, ওয়ান ব্যাংকে ২৯০ কোটি, ঢাকা ব্যাংকে ২৪১ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকে ১,৫৫৪ কোটি, পদ্মা ব্যাংকে ৫৩ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ১৮ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকে ২৭ কোটি, এনসিসি ব্যাংকে ৩৬ কোটি, হাজি ফাইন্যান্সে ৮.৬ কোটি, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সে ১০ কোটি এবং প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে ৩৪.৬ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে।
ঋণ পরিশোধ না করায় সম্পত্তি নিলামে
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সাইফ পাওয়ারটেকের সম্পত্তি ইতোমধ্যে নিলামে তুলেছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)।
ব্যাংকটির মহাখালী শাখার গ্রাহক সাইফ পাওয়ারটেকের প্রায় ৫১৮ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের দুটি বন্ধকি জমি গত ২০ মার্চ নিলামে তোলা হয়।
ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, নিলামে তোলা ওই দুটি জমির পরিমাণ প্রায় ৫৭ শতাংশের বেশি। ইউসিবির বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সাইফ পাওয়ারটেকসহ মোট তিনটি কোম্পানির সম্পত্তি নিলামে তোলা হয়েছে, যাদের অনাদায়ী ঋণের মোট পরিমাণ ৭৫৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
সাইফ পাওয়ারটেকের পাশাপাশি নিলামে থাকা অপর দুটি প্রতিষ্ঠান হলো ই-ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এবং ম্যাক্সন পাওয়ার লিমিটেড।
সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবসায়িক কার্যক্রম
সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড ২০১৪ সালে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) মাধ্যমে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৩৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। আইপিওতে প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করা হয় ৩০ টাকায়— যার মধ্যে ১০ টাকা ছিল অভিহিত মূল্য এবং ২০ টাকা ছিল প্রিমিয়াম।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে গ্যান্ট্রি ক্রেন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে সাইফ পাওয়ারটেক প্রথমবারের মতো বন্দরে কার্যক্রম শুরু করে।
চলতি বছরের জুলাইয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনএমসিটি) এর নিয়ন্ত্রণ নেয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পরিচালনাধীন চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেড, যার মাধ্যমে সাইফ পাওয়ারটেকের ১৭ বছরের কার্যকাল শেষ হয়।
তবে প্রতিষ্ঠানটি এখনও চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) পরিচালনা করছে, যেখানে মোট দুটি জেটি রয়েছে। পাশাপাশি সাইফ পাওয়ারটেক এনএমসিটি-১ পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে, যেখানে চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে পরিবহনের জন্য একটি নির্দিষ্ট জেটি রয়েছে।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ঢাকার কমলাপুরে স্থলভিত্তিক কনটেইনার ডিপো (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো–আইসিডি) পরিচালনা করে, যেখানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলপথে আসা কনটেইনার গ্রহণ ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
বন্দরের পাশাপাশি সাইফ পাওয়ারটেক লজিস্টিকস, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যাটারি উৎপাদন এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নির্মাণ খাতেও ব্যবসা পরিচালনা করছে।
