রূপপুর প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ কর অব্যাহতি দিল সরকার
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের ক্ষেত্রে রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট (এএসই)—রোসাটমের সহযোগী সংস্থা—বা তাদের মনোনীত এজেন্টের ওপর বিদ্যমান সব ধরনের কর অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে এএসই বা তাদের মনোনীত এজেন্ট রাশিয়ায় অর্থ পাঠানোর সময় যেন কোনো কর আরোপ না হয়—এ বিষয়ে নিশ্চয়তা চাওয়ার পর সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত হয়। এতে ঋণের অর্থ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সব ধরনের কর সম্পূর্ণভাবে মওকুফের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সভায় অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, রূপপুর প্রকল্পের সুদ ও আসল বাবদ ইতোমধ্যে যে অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে বা ভবিষ্যতে পরিশোধ করা হবে, সেই অর্থ এএসই বা তাদের মনোনীত এজেন্টের মাধ্যমে রাশিয়ায় পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এএসই ও তাদের মনোনীত এজেন্টকে কর অব্যাহতি প্রদান করতে হবে।
এছাড়া এতে আরও বলা হয়েছে, 'এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বিশেষ বিবেচনায় গৃহীত হয়েছে। ভবিষ্যতে এটি অন্য কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।'
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও এজেন্ট নিয়োগ
কর অব্যাহতির এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের এক জটিলতার সমাধান হলো।
ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোতে অর্থ পাঠানো সম্ভব হচ্ছিল না। ২০২২ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ঋণচুক্তি অনুযায়ী নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করলেও, পরবর্তী সময়ে নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০২৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো অর্থ পাঠাতে পারেনি।
নিষেধাজ্ঞা এড়াতে রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট বাংলাদেশে সোনালী ব্যাংকে একটি মার্কিন ডলার এসক্রো অ্যাকাউন্ট খোলে এবং স্পেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রইন ওয়ার্ল্ডকে তাদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকে জমাকৃত কিস্তির টাকা সংগ্রহ করে পরবর্তীতে রাশিয়ার ব্যাংকে স্থানান্তর করা হচ্ছে।
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর রিজার্ভ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার পরীক্ষামূলকভাবে পাঠিয়ে এই ব্যবস্থার সফলতা যাচাই করা হয়। পরবর্তীতে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি সোনালী ব্যাংকে থাকা এএসই'র এসক্রো অ্যাকাউন্ট থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়।
এরপর থেকে কিস্তি পরিশোধের শিডিউল অনুযায়ী নিয়মিতভাবে এএসই'র সোনালী ব্যাংকে ডলার অ্যাকাউন্টে অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে।
মূল ঋণচুক্তিতে আসল ও সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে করমুক্তির শর্ত থাকলেও, বিদেশি ঋণ পরিশোধে এজেন্টের কমিশনের ওপর ২০ শতাংশ কর প্রযোজ্য ছিল। তবে রাশিয়ার পক্ষ থেকে এজেন্ট কমিশনসহ সম্পূর্ণ করমুক্ত অর্থ স্থানান্তরের দাবি জানানোয় সরকার সম্প্রতি কর অব্যাহতির এই সিদ্ধান্ত নেয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কর অব্যাহতির নিশ্চয়তা পাওয়ার পর রোসাটম তাদের মনোনীত এজেন্টের মাধ্যমে শিগগিরই প্রকল্পের আসল, বকেয়া এবং ভবিষ্যৎ কিস্তির অর্থ স্থানান্তর শুরু করবে।
অন্যদিকে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক কর্মকর্তা জানান, এনবিআর চেয়ারম্যান যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পর ঋণ পরিশোধের ওপর বিদ্যমান সব ধরনের কর মওকুফ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
প্রকল্প সম্পর্কে
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় হবে ২২ হাজার ৫৩ কোটি টাকা এবং বাকি ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা রাশিয়ার ঋণ হিসেবে প্রদান করা হচ্ছে।
প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ২০১৩ সালে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ঋণচুক্তি এবং মূল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালে আরও ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও রাশিয়া।
সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)-কে জানান, আগামী ডিসেম্বর মাসে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হবে। বর্তমানে এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ট্যারিফ নির্ধারণের কাজ চলছে।
