সংসদে আসন বাড়িয়ে ৬০০ ও জেন্ডার–বান্ধব নির্বাচন আয়োজনের দাবি নারী অধিকার কর্মীদের

জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ করার আহ্বান জানিয়েছেন নারী ও মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের প্রস্তাব, এর অর্ধেক অর্থাৎ ৩০০ আসনে শুধুমাত্র নারী প্রার্থীরা সরাসরি ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
একইসঙ্গে তারা নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সহিংসতামুক্ত, জেন্ডার-বান্ধব ও নিরাপদ ভোট পরিবেশ তৈরির দাবি জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আয়োজিত সংলাপে এ দাবি জানানো হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে চার নির্বাচন কমিশনার এবং ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরিন পারভিন হক বলেন, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সংসদে আসন বাড়েনি। "আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, ৩০০ আসনের পরিবর্তে ৬০০ আসন করা হোক। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় দুটি আসন থাকবে—একটিতে শুধুমাত্র নারী প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, অন্যটিতে নারী-পুরুষ উভয়েই অংশ নিতে পারবেন। আমরা অনুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিও সমর্থন করি।"
নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরামের মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন, "যে সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে কথা বলেছি, সবাই নারীর সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে একমত। সংরক্ষিত নারী আসন থাকলে সেটিও যেন সরাসরি ভোটের মাধ্যমে হয়। দলগুলো যেন নির্দিষ্ট একটি শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেয় এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সব কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে।"
তিনি আরও বলেন, "নারী প্রার্থীদের জন্য সরকারিভাবে প্রচারণা তহবিল বরাদ্দ দিতে হবে, অনলাইন ও অফলাইন সহিংসতা রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে, এবং যোগ্য নারী প্রার্থীদের বিজয়ের সম্ভাবনাময় আসনে মনোনয়ন দিতে হবে।"
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের পরিচালক শাহনাজ সুমি বলেন, "যেসব এলাকায় সহিংসতা বা নাশকতার ঝুঁকি থাকে, সেখানে বিশেষ নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে।"
অ্যাসোসিয়েশন ফর লেবার অ্যান্ড ম্যান ডেভেলপমেন্টের উপনির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মুনি বলেন, "নির্বাচন কমিশনের স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি সংলাপ করা জরুরি। অনেক সময় নির্বাচনের পর নারীরা 'অমুককে ভোট দিয়েছে, অমুককে দেয়নি'—এমন অভিযোগে হামলার শিকার হন। কখনো এসব ঘটনার পেছনে সম্পত্তি দখলের মতো উদ্দেশ্যও থাকে। তাই আগে থেকেই এরকম ঝুঁকিপূর্ণ পকেটগুলো শনাক্ত করা দরকার।"
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য মাহা মির্জা বলেন, "ঢাকা ও চট্টগ্রামের শিল্প এলাকায় লাখ লাখ ভাসমান শ্রমিক কাজ করেন, কিন্তু তাদের অনেকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। বিশেষ করে নারী শ্রমিকেরা সময়ের অভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদে অংশ নিতে পারেন না। নির্বাচন কমিশনকে তাদের জন্য অন্তত দুই দিনের ছুটি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য ফ্রি বাস ও রেলসেবা চালু করতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "গৃহকর্মী নারী শ্রমিকদেরও ছুটি দেওয়া হয় না—এ বিষয়ে ইসিকে নজর দিতে হবে।"
মানবাধিকার কর্মী ইলিরা দেওয়ান বলেন, "পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় ভোট দিতে অনেক সময় মানুষকে ৪–৬ ঘণ্টা হেঁটে যেতে হয়। সেখানে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকলেও সাধারণ ভোটারদের জন্য কোনো সুবিধা নেই। এসব এলাকায় ডাকযোগে (পোস্টাল ব্যালট) ভোটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।"
উইমেন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন্নাহার মিষ্টি বলেন, "ভোটের সময় নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবন্ধী নারী ভোটারদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।"
নিজেরা করি সংগঠনের সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, "আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। তবে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে সরাসরি নির্বাচনের বিকল্প নেই। সংরক্ষিত আসন থাকলেও তা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে হওয়া উচিত, যাতে নারীরা জনগণের ভোটে সংসদে যেতে পারেন।"
তিনি আরও বলেন, "নারীদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয় এমন সহিংস সংস্কৃতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।"
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, "শুধু সিইসি জেন্ডার-ফ্রেন্ডলি নির্বাচনের আশাবাদ ব্যক্ত করলেই হবে না। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবাইকে জেন্ডার-সংবেদনশীল হতে হবে। এজন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "মনোনয়নের সময় নারী-বিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রার্থীদের বাদ দিতে হবে। প্রার্থীদের মানবিক গুণাবলি থাকা জরুরি।"
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, "নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত নির্বাচন চাই। নির্বাচনের আগে-পরে নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কুৎসা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা বন্ধে নির্বাচন কমিশনের কার্যকর ভূমিকা দরকার।"
নির্বাচন কমিশনার (অব.) আবুল ফজল মোহাম্মদ সানাউল্লাহ বলেন, "প্রতিবন্ধীদের ঘরে বসে ভোট দেওয়ার প্রস্তাব যুগান্তকারী ও বাস্তবসম্মত। এটি কার্যকর হলে সমাজের একটি বড় অংশ ভোটাধিকার প্রয়োগে সক্ষম হবে।"
তিনি আরও বলেন, "রাজনৈতিক দলগুলো যদি ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে না পারে, তবে তাদের সময়সীমা আর বাড়ানো হবে না।"
সংলাপের শেষ অংশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দিন বলেন, "ভোটের দিন যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আমরা এমন ব্যবস্থা নেব, যাতে নারী ও প্রতিবন্ধী ভোটাররা সহজে ভোটকেন্দ্রে আসতে পারেন। প্রয়োজনে নিচতলায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হবে।"
তিনি যোগ করেন, "একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে চাই। নারী ভোটাররা যেন নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন, সে জন্য আমরা কাজ করব। নির্বাচন কমিশন আন্তরিকভাবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে চায়—এই বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছে দিন।"