বিরোধীপক্ষকে দমনেই বেশি মনোযোগী ছিলেন শেখ হাসিনা: জবানবন্দিতে মাহমুদুর রহমান

জুলাই–আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিয়েছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১–এ ৪৬তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের পর বিরোধী পক্ষ দমনেই মনোনিবেশ করেন শেখ হাসিনা। শুরু থেকেই ইসলামি দলগুলোকে টার্গেট করা হয়।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ এবং একটি বিদেশি শক্তির সহায়তায় ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে বাংলাদেশে 'মব কালচার' সৃষ্টি করা হয়। তিনি আরও দাবি করেন, 'জুলাই ২০২৪ বিপ্লবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম এক ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন হয়েছে। এই ফ্যাসিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল একটি ম্যাটিকুলাস প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে, যেখানে দেশের রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি একটি বিদেশি শক্তিও জড়িত ছিল।'
এ মামলার অপর আসামিরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন 'অ্যাপ্রুভার' (রাজসাক্ষী) হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাকে আদালতে হাজির করা হলেও শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
জবানবন্দিতে মাহমুদুর রহমান বলেন, '২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা উপলব্ধি করেন যে, ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করতে হলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা জরুরি।' তার মতে, ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই মাসের মধ্যেই পরিকল্পিতভাবে বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। এই পরিকল্পনায় শেখ পরিবারের সদস্য ও শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সাবেক এমপি শেখ ফজলে নূর তাপস সরাসরি জড়িত ছিলেন।
তিনি অভিযোগ করেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেই তাপসসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিডিআরের কিছু সদস্যের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ওই হত্যাকাণ্ডের পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন। সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাপসকে কখনো বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।
তার মতে, শেখ হাসিনার সেনাবাহিনীবিদ্বেষ বাকশালের পতনের সময় থেকে। সেই বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অংশের ভূমিকায় একদলীয় শাসনের পতন ঘটে। তিনি দাবি করেন, 'শেখ মুজিবের মধ্যেও সেনাবিদ্বেষ ছিল।' এ প্রসঙ্গে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বই বাংলাদেশ: আ লিগ্যাসি অব ব্লাড থেকে উদ্ধৃত করে বলেন, 'স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব মাসকারেনহাসকে বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তানের মতো দানব সেনাবাহিনী গঠন করতে চান না।'
মাহমুদুর রহমানের দাবি, এই পারিবারিক সেনাবিদ্বেষ থেকেই শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ও মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চালান।
তার বক্তব্যে উঠে আসে, শাহবাগে প্রতিষ্ঠিত গণজাগরণ মঞ্চে ন্যায়বিচারের দাবি নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আন্দোলন চলেছে সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। তিনি বলেন, 'বিশ্বের সব ফ্যাসিস্ট সরকারই জনগণকে উন্মাদনায় আনার জন্য একটি গণশত্রু তৈরি করে। বাংলাদেশেও ২০১৩ সালে শাহবাগের মাধ্যমে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে নির্মূলের লক্ষ্যে ধারাবাহিক বিক্ষোভ আয়োজন করা হয়।'
তিনি আরও যোগ করেন, ''শাহবাগের বিক্ষোভকারীদের নির্দেশে সচিবালয়ের কর্মকর্তারা দাঁড়িয়ে ফাঁসির দাবিতে সমর্থন জানাতে বাধ্য হন। সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা শাহবাগী উদ্যোক্তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলে আখ্যা দেন। এমনকি মানসিকভাবে তিনিও নিজেকে শাহবাগে উপস্থিত মনে করতেন। ভারতীয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি সফরে এসে বলেন- 'প্রটোকল না আটকালে আমি নিজেও শাহবাগে দাঁড়িয়ে সংহতি প্রকাশ করতাম।' এতে প্রমাণিত হয়, ওই আন্দোলনে ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিল।"
মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, 'শাহবাগ উদ্যোক্তাদের ইসলাম বিদ্বেষী অবস্থান প্রকাশ পেতে শুরু করলে তার প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামের উত্থান ঘটে। এছাড়া তারা বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি তোলে, যেগুলোর মালিক ভিন্নমতের ছিলেন। ফলে ফাঁসির দাবি ছাড়াও ভিন্নমতের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ফ্যাসিবাদের চরিত্র উন্মোচিত করে।'
তার দাবি, আমার দেশ পত্রিকা এ নিয়ে জনগণকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছে এবং 'শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি' শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আরও দু–একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়ার পরেই বিচার কার্যক্রম শেষ করা হবে। দুপুরে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানান।