আবারও রপ্তানি শুরু করেছে আনন্দ শিপইয়ার্ড, তুরস্কে গেল ৫,৫০০ ডেডওয়েট টনের জাহাজ

আবারও জাহাজ রপ্তানি শুরু করেছে আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেড। তুরস্কের জন্য নির্মিত ৫,৫০০ ডেডওয়েট টন ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক মাল্টিপারপাস ভেসেল 'ওয়েস ওয়্যার' হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণশিল্পে নতুন মাইলফলক যোগ হলো।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে মেঘনাঘাট কারখানায় এ জাহাজ আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয় তুরস্কের প্রতিষ্ঠান নোপ্যাক শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং লিমিটেডের কাছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্ক দূতাবাসের বাণিজ্য কাউন্সেলর বিলাল বেলইউর্ত।
যদিও আনন্দ শিপইয়ার্ড আনুষ্ঠানিকভাবে রপ্তানিমূল্য প্রকাশ করেনি, তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র টিবিএসকে জানিয়েছে, এ জাহাজ রপ্তানিতে প্রায় ৭০ কোটি টাকা আয় হয়েছে।
কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, আন্তর্জাতিক মান অনুসারে নির্মিত এই ভেসেল 'ওয়েস ওয়্যার'-এ যুক্ত করা হয়েছে আধুনিক নকশা ও প্রযুক্তি। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ৩৪১ ফুট, প্রস্থ ৫৫ ফুট ও গভীরতা ২৫ ফুট। এতে রয়েছে ২,৭৩৫ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন—যা ১২ নট বেগে ৫,৫০০ টন পণ্য পরিবহনে সক্ষম। ইস্পাতের কয়েল, কয়লা, সার, খাদ্যশস্যসহ বিপজ্জনক সামগ্রী বহনের উপযোগী করেই জাহাজটি তৈরি করা হয়েছে।
এর আগে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইঞ্জিয়ান শিপিং কোম্পানি লিমিটেডের কাছে ৬,১০০ ডেডওয়েট টন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি জাহাজ রপ্তানি করেছিল—যা ছিল সেসময় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত অন্যতম বৃহৎ জাহাজ।
তুরস্কের কোম্পানির কাছে জাহাজ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ আইন আধুনিকায়ন করা হবে সমসাময়িক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে। তিনি বলেন, ''পোশাক খাতের পর জাহাজ নির্মাণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। এ শিল্প আরও এগিয়ে যাবে এবং এ খাতে বৈচিত্র্য আনতেই হবে।''
আনন্দ শিপইয়ার্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০০৮ সালে ডেনমার্কে কনটেইনার জাহাজ 'স্টেলা মেরিস' রপ্তানির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে প্রবেশ করার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশি–বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাছে ৩৫০টিরও বেশি জাহাজ সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ডেনমার্কের পর জার্মানি, নরওয়ে, মোজাম্বিক, যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশে মোট ১৭টি জাহাজ সরবরাহ করা হয়েছে।
৯ লাখ বর্গফুট এলাকায় বিস্তৃত আনন্দ শিপইয়ার্ড একসঙ্গে ১০ হাজার ডেডওয়েট টন ক্ষমতাসম্পন্ন আটটি জাহাজ নির্মাণ করতে সক্ষম। এর পাশাপাশি ড্রেজার ও আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন জাহাজও তৈরি করা হয় এখানে। সার্বক্ষণিক কার্যক্রম চালু রেখে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণশিল্পে এক গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড স্থাপন করেছে বলে উল্লেখ করেন কর্মকর্তারা।
আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহেল বারী বলেন, ''২০২২ সালের পর আমরা আবারও জাহাজ রপ্তানি শুরু করেছি। এবার তুরস্কে যে জাহাজ যাচ্ছে সেটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় এবং প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে আধুনিক জাহাজ।''
তিনি আরও বলেন, ''সোনারগাঁওয়ে জাহাজ নির্মাণের ঐতিহ্য রয়েছে, আর আনন্দ শিপইয়ার্ড সেই ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। একসময়ের অভিভাবকহীন এই গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন খাত এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সহযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে।''
তবে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পসুদে অর্থায়নের ক্ষেত্রে এখনও চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। আন্তর্জাতিক প্রথা অনুযায়ী একটি জাহাজের অর্থায়নের প্রায় ৮৫ শতাংশই ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে আসে। কিন্তু বাকি ১৫ শতাংশ—যার পরিমাণ ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা (২.৫ থেকে ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)—নিজেদের তহবিল থেকে জোগাড় করতে হয়।
তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো প্রায়ই এই অংশ দিতে অনীহা প্রকাশ করে, ফলে উৎপাদনের সময় কার্যকরী মূলধন আটকে থাকে এবং দেরি হয়।
"যথাযথ সরকারি সহায়তা পেলে একটি শক্তিশালী ও প্রতিযোগিতামূলক জাহাজ নির্মাণশিল্প গড়ে তোলা সম্ভব—যা দেশের উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করবে," যোগ করেন তিনি।
এর আগে চলতি বছরের জুলাইয়ে চট্টগ্রামভিত্তিক ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুটি টাগবোট রপ্তানির ঘোষণা দেয়। ৮০ টন বলার্ড পুল ক্ষমতাসম্পন্ন এএসডি টাগ 'গায়া' এবং ৬৫ টন বলার্ড পুল ক্ষমতাসম্পন্ন এএইচটি টাগ 'খালিদ' রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি ১৬ লাখ মার্কিন ডলার আয় করে।
বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণশিল্প
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের উদীয়মান জাহাজ নির্মাণকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। দক্ষ জনশক্তি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক মান মেনে চলা এ খাতের প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে।
বর্তমানে দেশে ৩০টিরও বেশি বড় শিপইয়ার্ড রয়েছে, যার কয়েকটি সরাসরি আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজ রপ্তানি করছে। এশিয়ার জাহাজ নির্মাণ শিল্পে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের পর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে অবস্থান শক্ত করছে। মাঝারি আকারের কার্গো ভেসেল, কনটেইনার জাহাজ, ট্যাঙ্কার ও ড্রেজার নির্মাণে ক্রমশ সুনাম অর্জন করছে বাংলাদেশ।
যদিও মূল গুরুত্ব এখনো দেশের চাহিদা মেটানো, গত এক দশকে জাহাজ রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে জ্বালানি পরিবহনের প্রায় ৯০ শতাংশ, কার্গো পরিবহনের ৭০ শতাংশ এবং যাত্রী পরিবহনের ৩৫ শতাংশই সম্পন্ন হয় জলপথে। এ বিপুল চাহিদা পূরণে বিভিন্ন আকারের প্রায় ৩০০টি শিপইয়ার্ড গড়ে উঠেছে। তবে এরমধ্যে মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণ করছে, যেখানে কাজ করছেন প্রায় ৩ লাখ শ্রমিক।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১০০টিরও বেশি জাহাজ নির্মাণকারী কোম্পানি এবং ১২০টির বেশি নিবন্ধিত শিপইয়ার্ড রয়েছে। তবে উদ্যোক্তাদের হিসাব মতে সক্রিয় শিপইয়ার্ডের সংখ্যা প্রায় ৩০০।
দেশের অভ্যন্তরীণ জাহাজের বাজার প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে, যেখানে রপ্তানি তুলনামূলক ধীর গতিতে বছরে ৫ থেকে ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। স্থানীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বার্ষিক বাজারমূল্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমান সক্ষমতা অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ২০টি জাহাজ রপ্তানি করতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ছোট আকারের জাহাজ রপ্তানিতে, বিশেষ করে ১২ হাজার ডেডওয়েট টন পর্যন্ত মাল্টিপারপাস ভেসেল, কার্গো ফিডার ও আঞ্চলিক সেবার যাত্রীবাহী ফেরিতে।
এ খাতে শ্রমব্যয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানে শ্রমব্যয় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কম—যেকারণে স্পষ্টতই বাংলাদেশ কিছুটা সুবিধাজনক স্থানে রয়েছে।