ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঠেকানোর পরিকল্পনা হয় গণভবনে: জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি মামুন

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঠেকাতে আগের দিন রাতেই গণভবেন বৈঠকে পরিকল্পনা করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ওই বৈঠকে তার বোন শেখ রেহানাসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন। ৫ আগস্ট কোথায়-কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে, সেসব সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় এই বৈঠকে।
আজ মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ০১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে জবানবন্দিতে এ কথা জানান আসামি থেকে রাজসাক্ষী হওয়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এদিন বেলা পৌনে ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তার সাক্ষ্যগ্রহণ চলে।
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ৩৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি।
জবানবন্দিতে আল-মামুন বলেন, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির বৈঠক হয়। এতে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর তৎকালীন প্রধান, তৎকালীন এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিজিএফআই-এনএসআই প্রধানসহ কমিটির ২৭ জন অংশ নেন। আমি নিজেও ওই বৈঠকে ছিলাম।
তিনি বলেন, বৈঠকে আন্দোলন দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন পেশ করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এর মধ্যেই চারপাশের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হওয়ায় বৈঠক মুলতবি করা হয়।
আল-মামুন বলেন, ওই রাতেই আমাদের আবার গণভবনে ডাকা হয়। সেখানে আমি, আনিসুল, আসাদুজ্জামান, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের তৎকালীন ডিজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ রেহানাও ছিলেন। আর বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন তৎকালীন ডিজিএফআই ও এসবিপ্রধান।
বৈঠকে ৫ আগস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। পুলিশ-সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর আমরা আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যাই। সেখানে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখে ফোর্স মোতায়েন করে কাঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মিটিং শেষে রাত সাড়ে ১২টায় আমরা চলে আসি।
জবানবন্দিতে সাবেক এই আইজিপি আরও বলেন, ৫ আগস্ট সকালে আমি পুলিশ সদর দপ্তরে আমার কার্যালয়ে যাই। এর মধ্যে উত্তরা-যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা প্রবেশ করতে থাকেন। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে জানতে পারি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি কোথায় যাবেন তা আমরা জানতাম না।
তিনি বলেন, এরপর বিকেলে আর্মির হেলিকপ্টার এসে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে আমাকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। হেলিকপ্টারে আমার সঙ্গে মনিরুল, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিব ও ডিআইজি আমেনা ছিলেন। পরের ধাপে হেলিকপ্টারে অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয়, অতিরিক্তি আইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যান্যদেরও সেখানে আনা হয়।
আল-মামুন জানান, গত বছরের ৬ আগস্ট আইজিপি হিসেবে তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালীন ৩ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আন্দোলন চলাকালীন ২৭ জুলাইয়ের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন সাবেক আইজিপি। তিনি বলেন, আন্দোলন চলাকালে আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আমরা নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখতে যাই। যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে কিছুক্ষণ অবস্থান করি। ওই সময় আসাদুজ্জামানকে মোবাইল ফোনে একটি ভিডিও দেখান ওয়ারি জোনের ডিসি ইকবাল। ভিডিওটি দেখিয়ে ইকবাল বলেন, গুলি করি, একজন মরে, একজন আহত হয়। সেই যায়। বাকিরা যায় না।