ঠিকাদার কালো তালিকাভুক্তি, মেরামত কাজের বিলম্বে ভেঙে পড়ছে মহাসড়ক
বর্ষা, বন্যা ও অতিরিক্ত বোঝাই ট্রাকের ভারে প্রতি বছর দেশের মহাসড়কগুলো ভেঙে যাচ্ছে, অথচ বরাদ্দ বাড়লেও তার সামান্য অংশই মেরামতে ব্যয় হচ্ছে। এতে করে গর্ত আর খানাখন্দে ভরা সড়ক ব্যবসাবাণিজ্যকে ধীর করছে, যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আর মানুষের প্রতিদিনের যাত্রা পরিণত হচ্ছে ভোগান্তিতে।

গত বছরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ একাধিক ঠিকাদারকে দুর্নীতির অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত করে। এই উদ্যোগেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কীভাবে রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাবশালী একটি চক্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল মেরামত ব্যবস্থা। এর ফলে দেশের বড় অংশের সড়ক মেরামত, সংস্কারের কাজেও স্থবিরতা নেমে আসে।
মেরামতের জন্য বরাদ্দ তহবিল ব্যয় হচ্ছে না
২০২৪-২৫ অর্থবছরে সারাদেশে মহাসড়ক মেরামতের জন্য ২,৬১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এর মধ্যে খরচ হয়েছে মাত্র ১,০৯৫ কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের ৪২ শতাংশ। ফলে ২,২০০ কিলোমিটার মেরামতের লক্ষ্য থাকলেও ১,২০০ কিলোমিটার সড়ক অবহেলিত রয়ে গেছে।

সে তুলনায় আগের অর্থবছরে বরাদ্দের ২,১০০ কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই ব্যয় হয়। এবার তার ব্যত্যয় হওয়ার পেছনে কর্মকর্তারা ২০২৪ -এর গণঅভ্যুত্থানের পর ঠিকাদার কালোতালিকাভুক্তি ও দরপত্র প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কথা উল্লেখ করেছেন।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, "রুটিন ও পিরিয়ডিক মেরামত কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। টেন্ডার যাচাই দীর্ঘায়িত হয়েছে, অনেক অভিযোগ জমেছে, আর অনেক এলাকায় নির্ভরযোগ্য ঠিকাদারই পাওয়া যাচ্ছিল না।"
এই অবহেলা সবচেয়ে নজরে পড়ছে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কে। মহাসড়কের জিরো পয়েন্ট থেকে কৈয়া পর্যন্ত অংশ দেখে বোঝার উপায় নেই— এটি একটি জাতীয় মহাসড়ক। পিচ ও খোয়া উঠে গেছে, বড় বড় গর্তে ভরা, কাদায় গাড়ি হেঁটে চলার মতো ধীরগতিতে চলছে।
একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে যশোর-খুলনা, সাতক্ষীরা-শ্যামনগর, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে।

সংকট দেশব্যাপী: যশোর-খুলনা মহাসড়ক
যশোর-খুলনা মহাসড়কের বসুন্দিয়া থেকে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার অংশ চলাচলের প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। টানা বর্ষণে গর্ত ও কাদায় ভরে এই অংশটি এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। এতে শুধু যাত্রী দুর্ভোগই নয়, স্থবির হয়ে পড়েছে বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য। বিশেষ করে, সার সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় কৃষকেরাও বিপাকে পড়েছেন।
সড়কটি দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল, নওয়াপাড়া নদীবন্দর, মোংলা সমুদ্রবন্দর ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান রুট। প্রতিদিন এই সড়ক দিয়ে হাজার হাজার পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করে। সড়কের পাঁচ কিলোমিটার অংশ এখন ভাঙা, খানাখন্দে ভরা, কোথাও হাঁটু কাদা, কোথাও আবার উঁচু-নিচু ঢিবি হয়ে গেছে। ২০২৩ সালে ৩২১ কোটি টাকার সংস্কার শেষ হওয়ার পর এবং আরও ১৭২ কোটি টাকার কাজ চলমান থাকা সত্ত্বেও সড়কটির বিভিন্ন অংশ আবারও ভেঙে পড়ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সবুর বলেন, "৩-৪ বছর ধরে এখানে সংস্কার কাজ চলছে। কিন্তু একদিকে কাজ শেষ না হতেই অন্যদিকে আবার রাস্তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থী থেকে রোগী—সবাই কষ্ট পাচ্ছে। আমরা দ্রুত স্থায়ী সমাধান চাই।"
ট্রাকচালক রাজিব হোসেন বলেন, "চেঙ্গুটিয়া থেকে বসুন্দিয়া পর্যন্ত অংশে গাড়ি নিয়ে চলা মুশকিল। প্রতিদিন গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে, দুর্ঘটনা ঘটছে।"
নওয়াপাড়া গ্রুপের ম্যানেজার রাজু আহমেদ বলেন, "দেশের মোট সার আমদানির বড় একটা অংশ নওয়াপাড়া নৌবন্দর দিয়ে আসে। কিন্তু রাস্তার এ অবস্থায় ট্রাক লোড নিতেই চাইছে না। ফলে সার সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে, কৃষক ক্ষতির মুখে পড়ছে।"
নওয়াপাড়া ব্যবসায়ী সমিতির নেতা নূরে আলম বাবু বলেন, "মহাসড়কের করুণ অবস্থা ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় অচল করে দিয়েছে। সার ও খাদ্যশস্য সরবরাহ বন্ধ হলে এর প্রভাব পড়বে কৃষি উৎপাদনে, যা খাদ্য সংকটও তৈরি করতে পারে।"

সওজ খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া জানান, "মহাসড়কের মাটির গুণাগুণ খারাপ, আবার ওভারলোড যানবাহনও চলাচল করে। তাই দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বুয়েটের পরামর্শে (কংক্রিটের) ঢালাই রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। চার কিলোমিটার শেষ হয়েছে, আরও ২.৩ কিলোমিটারের কাজ চলছে। মোট আট কিলোমিটার ঢালাই রাস্তা করা হবে। সব কাজ শেষ হতে ১৮ মাস লাগবে।"
সাতক্ষীরা-শ্যামনগর মহাসড়ক
সরেজমিনে দিয়ে দেখা যায়, সাতক্ষীরা-শ্যামনগর মহাসড়কটি আর আস্ত নেই। ভাঙাচোরা ৬২ কিলোমিটার সড়কে সীমাহীন দুর্ভোগে চালক যাত্রীরা। মহাসড়কে গর্ত, খানাখন্দে এখন বৃষ্টির পানি, দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। জোড়াতালি দিয়ে চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে সড়ক বিভাগ, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। বৃষ্টির মৌসুম শেষে শুরু হবে সংস্কার কাজ।

বাসচালক আব্দুল কাদের জানান, "ভাঙা সড়কের কারণে বাসের ইজ্ঞিনসহ নানান যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গেল ৩-৪ বছর ধরে সড়কটির এমন বেহাল দশা থাকলেও—মেরামতের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখছি না। ট্রাকচালকদের অভিযোগও একই।
সড়কটি নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারাও চরম ক্ষুব্ধ। দেবহাটা এলাকার রাশেদুজ্জামান বলেন, "হেঁটেও চলাচল করার মত পরিস্থিতিও নেই সড়কটিতে।"
সাতক্ষীরা সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার পারভেজ বলেন, "সাতক্ষীরা থেকে ভেটখালি পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার সড়কে মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে। এটি কাঁটাতে ছয়টি প্যাকেজে আমাদের টেন্ডার আহব্বান করা হয়েছিল। পাঁচটি ইতোমধ্যে টেন্ডার শেষ হয়েছে, কার্যাদেশও প্রদান করা হয়েছে। বৃষ্টির মৌসুম শেষ হলেই সড়ক মেরামতের কাজ শুরু হবে। এছাড়া একটি প্যাকেজের কার্যক্রমও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সবমিলে সড়কটিতে ৫৭০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করা হবে।" কাজ শেষ হলে মানুষের দূর্ভোগ থাকবে না বলে জানান এই কর্মকর্তা।
ঠিকাদারদের চক্রের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান
গত অর্থবছরের সওজের ঠিকাদারদের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হয়। কারণ আগে দেখা যেত ঘুরেফিরে একই ঠিকাদারই কাজ পেত। কাজ পেতে দরপত্র আবেদনের সঙ্গে 'ভুয়া কাগজপত্র' দিত ঠিকারদার, যা তাকে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে রাখত।

২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এসব বিষয়ে সওজ শুদ্ধি অভিযান জোরদার করে। যাচাই-বাছাইয়ের পর কালোতালিকাভুক্ত করে ৪৩ ঠিকাদারকে। এই প্রক্রিয়ার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৭৫টি দরপত্রের প্রক্রিয়াকরণ বিলম্বিত হয়। এ ছাড়া গত অর্থবছরে ছাত্র -জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরে প্রশাসনে অস্থিরতার কারণেও দপরপত্র প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়েছে।
সওজ খুলনা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ জাকির হোসেন বলেন, গত অর্থবছরে, মেরামতের জন্য ১৪টি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু ঠিকাদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ঘাটতি ছিল। কোথাও একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়েছে, এই কারণে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করতে হয়েছে। এর মধ্যে আমরা ৮টি প্যাকেজে ১৪০ কোটি টাকার কার্যাদেশ দিতে পেরেছি। যদিও এই কার্যক্রশ শেষ হয়েছে অর্থবছরের শেষের দিকে। তবে এখন ঠিকাদারদের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
সওজের কুমিল্লা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা বলেন, "আমার অঞ্চলে রক্ষণাবেক্ষণের কোনো কাজই করা যায়নি। যেকারণে সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেছে। গত অর্থবছরে ১৩টি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসায় প্রধান কার্যলয় থেকে চূড়ান্ত কার্যাদেশ প্রদানের সম্মতি পাওয়া যায়নি। আবার দরপত্র আহ্বান করতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬ দরপত্রে ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখনো বাকি ৭টি দরপত্রের সমাধান হয়নি।"
সওজ যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া বলেন, ঠিকাদারদের সমস্যা এখনো শেষ হয়নি। এটা নিয়ে কাজ চলছে। গত অর্থবছরে যশোরে রক্ষণাবেক্ষণের দুটি দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি শেষ করতে হয় মার্চের দিকে এসে। আরেকটি শেষ করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে অর্থবছরের শেষ মাস- অর্থাৎ জুনে। এই দুটি প্যাকেজে ৫০ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় ক্রয় কাজ, যার ক্রয়মূল্য ৪০ কোটি টাকা— সেটির ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো ঝুলে আছে।
নাম প্রকাশ না করা্র শর্তে সওজের এক কর্মকর্তা জানান, "ঠিকাদারদের যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি এখনো শেষ হয়নি। তবে চূড়ান্ত সমাধানের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, চলতি অর্থবছরে দ্রুত ঠিকাদার-কেন্দ্রীক সমস্যা সমাধন করা সম্ভব হবে। ফলে কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই সড়ক মেরামতের কাজ সম্পন্ন করা যাবে।"
মেরামতের বিলম্বে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে
সওজের কর্মকর্তারা জানান, সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণ না করলে ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, "যে কাজ ৩০ টাকায় করা যেত, এক বছর পর তা ১০০ টাকা লাগবে। গর্ত বড় হলে, কার্পেট উঠে গেলে খরচ বেড়ে যায়।"
উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, "ধরুন যে মেরামতের কাজ এখন ৩০ টাকা দিয়ে করা যাবে— তা যদি এক বছর পরে করা যায় তার জন্য প্রায় ১০০ টাকা খরচ করতে হবে। কারণ সড়কের খানাখন্দের পরিমাণ বেড়ে কার্পেটিং উঠে যায়। এভাবে খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে।"
তিনি বলেন, গত অর্থবছরে যে ১,২০০ কিলোমিটার সড়ক মেরামত করা যায়নি, সেগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে মেরামত করা হবে চলতি অর্থবছরে। কিন্তু, চলতি অর্থবছরে আমরা মাত্র ২,৫০০ কিলোমিটার সড়ক মেরামতের জন্য বরাদ্দ পেতে পারি, যার মধ্যে গত অর্থবছরের ১,২০০ কিলোমিটারও থাকবে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের পরিমাণ বেশি হলেও পর্যাপ্ত বরাদ্দ আমরা পাচ্ছি না। ফলে যেসব সড়ক এবছর মেরামত করার দরকার ছিল তা করা যাবে না। এতে এসব সড়কের মেরামত ব্যয় আগামী বছর বেড়ে যাবে। এইভাবে একটি দুষ্টচক্রে পড়ে যাচ্ছে সড়ক মেরামতের কাজ।
ক্ষতিগ্রস্ত বিপুল সড়ক, কিন্তু মেরামতের টাকা অপর্যাপ্ত
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) হিসাব অনুযায়ী, তাদের ২২ হাজার কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্কের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার কিলোমিটারই এখন মেরামতের প্রয়োজন। কিন্তু সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে বছরে কমপক্ষে ৭ হাজার কোটি টাকা লাগলেও, বরাদ্দ আটকে আছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার আশেপাশে।
গত বছরের ভারী বর্ষণ আর বন্যায় সড়কের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অতিরিক্ত পণ্যবাহী ট্রাকের চাপ।
ব্যবসায়ীদের চাপে বাংলাদেশ যানবাহনের ওজনসীমা ২৩ টনে উন্নীত করেছে, যেখানে বৈশ্বিক মান ১৬ টন। কিন্তু বাস্তবে অনেক ট্রাক সেই সীমাও অতিক্রম করে। ফলে সড়কে ফাটল ধরে, কার্পেটিং বসে যায়, আর তাতে বৃষ্টির পানি জমে গর্ত তৈরি হয়।
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা এবং তাপমাত্র বৃদ্ধির কারণেও সড়ক দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া আমদানি করা মানহীন বিটুমিনও এর পেছনে ভূমিকা রাখছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
পারফরম্যান্সভিত্তিক সড়ক তহবিলের প্রয়োজন বাংলাদেশে
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশকে এখন জোড়াতালি দেওয়া মেরামত বা প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থার বদলে পারফরম্যান্সভিত্তিক রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতিতে যেতে হবে।
বুয়েটের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. শামসুল হক বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ অবকাঠামো উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাস্তা নির্মাণ মানেই এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও নেওয়া। কারণ, যেকোনো অবকাঠামো একসময় নষ্ট হবেই। যদি সঠিক সময়ে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা না থাকে, তবে মেরামতের বদলে পুনর্বাসন বা রিহ্যাবিলিটেশন করতে হয়—যার খরচ অনেক বেশি। তাই রাস্তা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ এখন একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে, এবং প্রতিটি দেশে এটি একটি স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিসে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, আগে প্রচলিত ধারণা ছিল—গর্ত হলে ঠিকাদার এনে তা ভরাট করা হবে। এটাকে বলা হয় রিঅ্যাক্টিভ মেইনটেন্যান্স। কিন্তু এর ফলে মানুষের ভোগান্তি বেড়ে যায়। আধুনিক ধারণা হলো প্রোঅ্যাকটিভ মেইনটেন্যান্স—মানে শুরুতেই কন্ট্র্যাক্টর নিয়োগ দেওয়া। উন্নত বিশ্বে প্রতি কিলোমিটার রাস্তায় বছরে কত খরচ হবে—তা আগে থেকেই জানা থাকে। যেমন সওজের ৫০ বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলা হয়েছে, প্রতি বছর প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা লাগবে। এর ফলে ভবিষ্যতে তথ্যভিত্তিকভাবে প্রতি বছরের বাজেট পরিকল্পনা করা সম্ভব হয়।
"বর্তমানে সারা বিশ্বে পারফরম্যান্স-ভিত্তিক মেইনটেন্যান্স প্র্যাকটিস চালু হয়েছে। এর আওতায়—বছরের শুরুতেই ঠিকাদায় নিয়োগ দেওয়া হয় এই যে—কোনো গর্ত থাকবে না, কোনো ক্র্যাক থাকবে না, রাস্তা উঁচু-নিচু হবে না, সাইন, মার্কিং ঠিক থাকবে। প্রতি দুই মাস পরপর পারফরম্যান্স যাচাই করা হবে। শর্ত পূরণ করলে তবেই অর্থ প্রদান করা হবে।"
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে এখনো প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থায় ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। ছোটখাটো কাজের জন্য নয়, বরং বড় কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। এই ধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
"বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা সড়ক তহবিল রয়েছে। টোলের টাকা, লাইসেন্স ফি, এবং উন্নয়ন কাজের ১ শতাংশ এই তহবিলে জমা হয়। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগীরাও ম্যাচিং ফান্ড যোগ করে তহবিলকে শক্তিশালী করে। এমন ব্যবস্থা থাকলে আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ তহবিলের জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না"- যোগ করেন তিনি।
নতুন প্রকল্পের চাপে মেরামতের বরাদ্দে কাটছাঁট
অনেক স্থানে নতুন রাস্তা নির্মাণের প্রকল্প চলমান থাকায়—মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এর একটি বড় উদাহরণ ঢাকা-সিলেট মহসড়ক। এই মহাসড়কের আশুগঞ্জ গোলচত্বর থেকে সরাইল-বিশ্বরোড মোড় পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশ খানাখন্দের কারণে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটির বিভিন্ন অংশে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। এর ফলে প্রতিনিয়ত সৃষ্ট যানজটে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মহাসড়ক ব্যবহারকারীদের।
আশুগঞ্জ গোলচত্বর থেকে বিশ্বরোড মোড় পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে যানবাহনগুলোর সময় লাগছে ৭-৮ ঘণ্টা। মহাসড়কে এই ভোগান্তির মাত্রা বৃষ্টির সময় আরও বাড়ে।
সড়কপথে আন্ত:দেশীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত প্রায় ৫১ কিলোমিটার সড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালে। ৫,৭৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির কাজ করছে ভারতীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এফকন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। তবে ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা, করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ভাবসহ নানা জটিলতায় শুরু থেকেই ধীরগতিতে চলছে নির্মাণ কাজ। কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়ানোর পর এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৫৭ শতাংশ।
তিনটি প্যাকেজে প্রকল্পটির কাজ চলছে। এর মধ্যে প্যাকেজ-১ (আশুগঞ্জ গোলচত্বর থেকে বিশ্বরোড মোড়) এর কাজ ৬২ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্যাকেজ-২ (বিশ্বরোড মোড় থেকে তন্তর বাজার) এর কাজের অগ্রগতি ৫২ শতাংশ। আর প্যাকেজ-৩ (তন্তর বাজার থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর) এর কাজ এখনও পর্যন্ত শুরুই করতে পারেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
এরই মধ্যে গেল বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নিরাপত্তাহীনতার কারণ দেখিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী ভারতে চলে যান। পরবর্তীতে দীর্ঘ আলোচনার পর গত বছরের নভেম্বর থেকে চলে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাংলাদেশে ফিরতে শুরু করেন। তবে এখনও অভ্যন্তরীণ কিছু জটিলতায় কাজ চলছে ঢিমেতালে।
প্রকল্প ব্যবস্থাপক শামীম আহমেদ বলেন, "মূলত এই অংশটি প্রকল্পের আওতায় পড়ায় সরকারের রাজস্ব খাত থেকে সংস্কার কাজ করা যাচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানই সংস্কার কাজ করবে। তবে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে জরুরি-ভিত্তিতে সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ আগামী ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধির জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। তবে তাদের কাজের গতি বাড়িয়ে দ্রুত শেষ করার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে" বলে জানান তিনি।
এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ প্রায় শেষদিকে। কিন্ত চলতি অর্থবছরের বৃষ্টির কারণে এই প্রকল্পটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এই প্রকল্পে ১৯০ কিলোমিটারের মধ্যে ১০০ কিলোমিটার তৈরি হচ্ছে বিটুমিন দিয়ে। আর ৯০ কিলোমিটার কংক্রিট দিয়ে তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি অতিবৃষ্টির কারণে এই সড়কের বিটুমিন অংশের অনেক স্থানে ছোটখাট গর্ত তৈরি হয়েছে। কিন্তু, কংক্রিটের অংশে কোনো সমস্যা হয়নি।
[টিবিএসের যশোর প্রতিনিধি মনোয়ার আহমেদ, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আকরামুল ইসলাম, খুলনা প্রতিনিধি আউয়াল শেখ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি আজিজুল সঞ্চয় এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন।]