জুলাই সনদ: বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্বেগ

রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো জাতীয় জুলাই সনদের খসড়ায় বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি বলে জানিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। খসড়ায় বেশ কিছু অসামঞ্জস্যও রয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একাধিক সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমত না হওয়ায় ভিন্নমত বা 'নোট অব ডিসেন্ট 'দেওয়া হয়েছে। এতে করে এর বাস্তবায়ন ও সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে দলগুলো। তাদের মতে, 'নোট অব ডিসেন্ট' থাকলে জুলাই সনদ কার্যকর করা যাবে না। ভবিষ্যতে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তারা সংসদে এসব বাস্তবায়ন করবে না।
খসড়ার ১০টি প্রস্তাবে 'নোট অব ডিসেন্ট' দিয়েছে বিএনপি। দলটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, চূড়ান্ত খসড়ার আলোচনায় বিএনপি কিছু ছাড় দিতে পারে। বিশেষ করে সংসদের উচ্চকক্ষের পিআর পদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পদ্ধতিসহ দুই-তিনটি বিষয়ে সমঝোতার সুযোগ রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, "জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় কিছু অসামঞ্জস্য রয়েছে। পাশাপাশি কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। এগুলো আমাদের মতামতে তুলে ধরা হবে। সনদের চূড়ান্ত খসড়া পর্যালোচনা করে আগামী ২০ আগস্টের মধ্যে মতামত জানাবে বিএনপি।"
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী'র কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, "জুলাই সনদ আলোচনার ভিত্তিতে যেভাবে নির্ধারিত হয়েছে, সেখানে কোনো গ্যাপ আছে কি না দেখতে হবে। সনদ চূড়ান্ত হওয়ার পর তা আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনতে হবে, তারপর বাস্তবায়ন হবে। এই ধাপগুলো এখনো সম্পন্ন হয়নি। তাই এখনো এটি কেবল লিখিত সনদ মাত্র।"
তিনি আরও বলেন, "আইনি দলিল না হলে এর কোনো কার্যকারিতা নেই। প্রথমে এটিকে আইনি দলিল করতে হবে, তারপর বাস্তবায়ন। এই দুটি হলে আইনি ভিত্তি রচিত হবে। আমরা আশা করছি, জুলাই সনদ কার্যকর হলে এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচন হলে সংস্কার নিশ্চিত হবে, নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে। সরকার এটাই করবে বলে প্রত্যাশা রাখি।"
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা আবারও হতাশ হয়েছি। আমরা যে বাস্তবায়নের কথা বলেছি তার সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। কিছু বিষয় নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও সেগুলো চিহ্নিত করা হয়নি। বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়েও কিছু বলা নেই। সব মিলিয়ে খসড়া দেখে আবারও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। আশা করি, কমিশন আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে বিভ্রান্তি দূর করবে।"
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, "জুলাই সনদের আইনি দিক বা বাস্তবায়ন নিয়েও নিজেদের মধ্যে আরও আলোচনা প্রয়োজন। 'নোট অব ডিসেন্ট' বিষয়গুলো আগামী পার্লামেন্টে আলোচনার মধ্যে আসবে। প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়নের কথা বলেছিলেন। কিন্তু 'নোট অব ডিসেন্ট' থাকলে তো তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এখনও সময় আছে, দেখা যাক আলোচনায় কী হয়। বিএনপির অবস্থান ভিন্ন, আমরা আমাদের মতামত উপস্থাপন করব। উচ্চকক্ষের গঠন প্রক্রিয়ার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।"
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, "'নোট অব ডিসেন্ট' দিয়ে কোনো ঐকমত্য হয় না। যারা ভিন্নমত দিল, তারা ক্ষমতায় গেলে তা বাস্তবায়ন করবে না। অর্থাৎ এখানে ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের কাছে মনে হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আসলে বিভাজন সৃষ্টিকারী সনদের খসড়া পাঠিয়েছে। এই ধরনের সনদে সব দল একমত হতে পারবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি নিয়ে আলোচনায় না বসার সিদ্ধান্ত আমরা আগেই নিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম, কমিশন এই বিষয়টিকে আলোচনার বাইরে রাখবে বা অন্তত আমাদের সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু তারা কিছুই বলেনি। দলীয় ফোরামে আলোচনা করেই আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। অনেক বক্তব্য দেখে মনে হয়েছে, এটা একপেশে এবং বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর মতামতের প্রতিফলন। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া আশ্বাসও রাখা হয়নি।"
বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান ও ১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, "জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে একমত না ভিন্নমত—তা নিয়ে আজ (সোমবার) আলোচনায় বসব। 'নোট অব ডিসেন্ট' থাকলে আগামী দিনে বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাবে। প্রশ্নবোধক অবস্থা তৈরি হতে পারে। তবে আমরা কিছুটা উদারতা দেখাতে পারি। জোটের ফোরামে আলোচনা করেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত জানানো হবে।"
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আগে আমাদের যে খসড়া দেওয়া হয়েছিল, শনিবার দেওয়া জুলাই সনদের সঙ্গে সেটির অনেক অসামঞ্জস্য রয়েছে। জুলাই সনদে যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হয়েছে এবং যেগুলো অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল। আগামী সংসদে দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও ছিল। নির্বাচিত সংসদ প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে—এমনটা বলা হয়েছিল। কিন্তু এবারের জুলাই সনদে সময়সীমা নিয়ে কিছু বলা হয়নি।"
তিনি আরও বলেন, "কমিশনের যেসব প্রস্তাব-সুপারিশে ঐকমত্য হয়েছিল, সেগুলোই বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু জুলাই সনদে দেখা যাচ্ছে, যেসব প্রস্তাব-সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হয়নি, সে বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই।"
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও দলীয় মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, "সংকটের মূল জায়গা হলো নির্বাচন পদ্ধতি। বিশেষ করে নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। অথচ এটি ছিল অনেক দলের দাবি। ফলে নির্বাচন নিয়ে সংকট থেকেই যাবে। তবে আমরা মনে করি, অন্য সংস্কারগুলো সঠিক আছে। কিছু বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও বৃহত্তর স্বার্থে মেনে নিয়েছি।"
তিনি আরও বলেন, "যেসব বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন, সেগুলোর একটি আইনি ভিত্তি থাকা জরুরি। খসড়ায় বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে কিছু বলা হয়নি। আমরা চাই, এই অন্তর্বর্তী সরকারই যেন এটিকে চূড়ান্ত করে যায়। যাতে পরবর্তী সরকার জুলাই সনদের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে।"
এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা এখন সংস্কার বাস্তবায়নের পথ ও পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করব। এ কারণেই খসড়ায় সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন পদ্ধতি উল্লেখ নেই। সবার মতামত নিয়ে সংযোজন-বিয়োজন করেই চূড়ান্ত করা হবে জাতীয় জুলাই সনদ।"