অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর: রাস্তা থেকে রেল—উন্নয়ন প্রকল্প চলছে ধীরগতিতে

'চায়ের দেশ' শ্রীমঙ্গল, ঢাকার মাত্র ১৭৬ কিলোমিটার দূরে। কাগজে-কলমে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার গতিতে চললে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টায় পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে এই পথ পাড়ি দিতে লাগে আট থেকে নয় ঘণ্টা।
কারণ, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বেহাল দশা। এমন গর্তে ভরা এই সড়ক শুধু সময় ও শক্তি নষ্ট করে না, যানবাহনেরও মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। ২০২১ সালে সরকার ঢাকা (কাঁচপুর) থেকে সিলেট পর্যন্ত ২০৯ দশমিক ৩২৮ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু করেছিল। লক্ষ্য ছিল ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করা। কিন্তু প্রায় পাঁচ বছরেও অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ, গত এক বছরে তো কার্যত কোনো কাজই হয়নি।
এই বিলম্বে অর্থনৈতিক ক্ষতি ব্যাপক। গত দেড় দশকে গ্যাস সুবিধার কারণে গড়ে ওঠা অসংখ্য কারখানা—টেক্সটাইল মিল, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিট, কেমিক্যাল প্ল্যান্ট, সিরামিক শিল্প—আজ চরম সমস্যায়।
আর চা বাগানগুলোর দুর্ভোগ তো দীর্ঘদিনেরই। শ্রীমঙ্গলের একটি চা বাগানের সিইও টিবিএসকে বলেন, 'এমন মনে হয়, সড়কের এই অবস্থা দেখার মতো কেউ নেই।'
সমস্যা শুধু সিলেটেই নয়, সারা দেশেই বহু প্রকল্প হয় থেমে আছে, নয়তো গতি শ্লথ। সরকার পরিবর্তনের পর অনেক প্রকল্প পরিচালক ও ঠিকাদার নীরবে সরে গেছেন, ফেলে রেখেছেন অর্ধসমাপ্ত কাজ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নতুন প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়া কঠোর করলেই সমাধান হবে না; বাস্তবায়নে কাঠামোগত সংস্কার না হলে একই জটিলতা চলতেই থাকবে।
গত মাসে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) একটি সার্কুলারে নির্দেশ দিয়েছে, বিদেশি অর্থায়নকৃত প্রকল্পে চুক্তি সইয়ের আগে ভূমি অধিগ্রহণ, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ও টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
তবে এর কার্যকারিতা সময়ই বলে দেবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মাসরুর রেয়াজ বলেন, নতুন প্রকল্পগুলো অনুমোদনের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই হচ্ছে, ব্যয় পর্যালোচনা ও অর্থের যোগান বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু চলমান প্রকল্পের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যয় পর্যালোচনা হয় না। অনেক অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও চলছে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন এসব প্রকল্প বাতিলে কথা বলা হলেও বর্তমান সরকার মাত্র কয়েকটি প্রকল্প বাতিল করেছে। উন্নয়ন প্রকল্পে অনিময় , দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করতে হলে চলমান প্রকল্পগুলোর যাছাই-বাছাই কাযক্রম এবং তদারকি জোরদার করতে হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে পুরোনো চিত্র
অন্তবর্তী সরকারের সময় বড় অবকাঠামো প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ার প্রবণতা কমানোর আশা থাকলেও পরিস্থিতি বদলায়নি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ে শেষ না হলে গড়ে ১৫ শতাংশ ব্যয় বাড়ে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের মতে, নতুন প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে সরকার সতর্কভাবে যাচাই-বাছাই করলেও চলমান প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় বা অগ্রগতি পর্যালোচনায় তেমন উদ্যোগ নেই।
উদাহরণ হিসেবে তারা গাজীপুর–এয়ারপোর্ট বিআরটি প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেন। গত ২৭ জুলাই একনেক সভায় ব্যয় ও সময় বাড়ানোর প্রস্তাব ফেরত পাঠানো হয় এবং প্রকল্পের মূল অর্থায়নের উৎস ও নকশা প্রণেতাদের খুঁজে বের করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
ঢাকা-সিলেট ও আশুগঞ্জ-আখাউড়া
ঢাকা–সিলেট চার লেন উন্নয়ন প্রকল্পের চার বছরের বাস্তবায়নে অগ্রগতি মাত্র ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে ১৯২ দশমিক ৩২ কিলোমিটার সড়কে কোনো কাজই হয়নি। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে, বর্ষায় চলাচল কঠিন হয়ে পড়ছে এবং যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।
একইভাবে ভারতীয় ঋণে অর্থায়িত আশুগঞ্জ–আখাউড়া চার লেন প্রকল্পও কার্যত স্থবির হয়ে আছে। কাগজে অগ্রগতি ৫৮ শতাংশ হলেও ঠিকাদার সাইটে নেই। প্রকল্পের আওতায় থাকায় সড়ক ও জনপথ বিভাগ নিয়মিত সংস্কার কাজও করতে পারছে না, ফলে রাস্তায় ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।
আশুগঞ্জ গোলচত্বর ও সরাইল–বিশ্বরোড মোড়ে এই গর্তের কারণে নিয়মিত যানজট হচ্ছে। ১২ কিলোমিটারের এই পথ পাড়ি দিতে লাগছে ৭–৮ ঘণ্টা। বর্ষায় গর্তভরা রাস্তার কারণে ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়।
আশুগঞ্জ–আখাউড়া চার লেন মহাসড়ক প্রকল্পের পরিচালক শামীম আহমেদ বলেন, মূলত প্রকল্পের আওতায় পড়ায় সরকারের রাজস্ব খাত থেকে সংস্কার কাজ করা যাচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানই সংস্কার করবে। তবে জরুরি ভিত্তিতে কিছু সংস্কার চলছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধির জন্য আবেদন করা হয়েছে।'
কাজের গতি বাড়িয়ে দ্রুত শেষ করার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
পায়রা বন্দর ও অন্যান্য মেগা প্রকল্প
বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর পুনর্মূল্যায়ন করছে। পলি জমার কারণে প্রতি বছর ব্যাপক ড্রেজিং খরচ লাগবে বলে নদীবন্দর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বর্তমানে পায়রা বন্দরকেন্দ্রিক তিনটি প্রকল্পের ব্যয় ১৫ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা।
এছাড়া মেট্রোরেল এমআরটি-৫ (দক্ষিণ রুট) প্রকল্পের ব্যয় ৬ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা কমিয়ে ৪৭ হাজার ৭২১ দশমিক ৪৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। তবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা রেল সংযোগসহ অন্যান্য বড় প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনা হয়নি।
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিলে ধীরগতি
রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে মাত্র কয়েকটি বাতিল হয়েছে। কৃষি ও পানি সম্পদ বিভাগ ৫ হাজার কোটি টাকার ১০টি অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাতিলের সুপারিশ করলেও মন্ত্রণালয়ের আপত্তিতে তা হয়নি।
একই অবস্থা অবকাঠামো, সামাজিক খাত, শিল্প ও জ্বালানি বিভাগেও।
নতুন মেগা প্রকল্প অনুমোদন
গত এক বছরে সরকার কয়েকটি বড় প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বে টার্মিনাল প্রকল্প, যার মোট ব্যয় ১৩ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৯ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা বিশ্বব্যাংক ঋণ।
কালুরঘাট রেল-সড়ক সেতুর প্রকল্পের ব্যয় ১১ হাজার ৫৬০ দশমিক ৭৭ কোটি টাকা নির্ধারিত হয়েছে। সংশোধিত মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা হয়েছে।
এছাড়া মোংলা বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৩ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা চীনা ঋণ।