এনসিটি পরিচালনায় বর্তমান জনবল নিয়েই ৬ মাসের জন্য নৌবাহিনীকে দায়িত্ব নেওয়ার সুপারিশ সরকারের

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) আগামী ৭ জুলাই থেকে পরবর্তী ছয় মাসের জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে পরিচালনার সুপারিশ করেছে সরকার। সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
নৌবাহিনী বিদ্যমান জনবল ব্যবহার করেই টার্মিনাল পরিচালনা করবে। প্রয়োজনে আগের অপারেটরদের কাছ থেকেও সহায়তা নিতে পারবে। পাশাপাশি এই অন্তর্বর্তী সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চাইলে নতুন অপারেটরও নিয়োগ দিতে পারবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল পরিচালনায় সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। বুধবার (২ জুলাই) চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামানের উপস্থিতিতে বন্দরের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেন, "নৌবাহিনী ও বন্দর কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর হবে। নৌবাহিনীর একজন কমান্ডারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হবে এবং বন্দর চেয়ারম্যান তাকে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেবেন।"
অন্যদিকে, সাইফ পাওয়ারটেক জানিয়েছে, এনসিটি পরিচালনায় তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত প্রায় ৩,৮০০ শ্রমিক বহাল থাকবে এবং তারা নৌবাহিনীকে শতভাগ সহযোগিতা করবে।
এই কর্মীরা সাইফ পাওয়ারটেকের হয়েই কাজ করবেন, নাকি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের হয়ে—তা নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে। এনসিটির কার্যক্রম চালিয়ে যেতে প্রতিষ্ঠানটি সর্বাত্মক সহায়তা দেবে বলেও জানানো হয়েছে।
গত ১৭ বছর ধরে এনসিটিতে টার্মিনাল অপারেটর হিসেবে কাজ করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক। চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম আলোচিত এবং বিতর্কিত এ প্রতিষ্ঠান দক্ষতার সঙ্গে টার্মিনাল পরিচালনা করলেও, বারবার ডিপিএম পদ্ধতিতে তাদের নিয়োগ দেওয়া নিয়ে নানা সমালোচনা হয়েছে।
আগামী ৭ জুলাই সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর আগে, ১৮ জুন বন্দর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় যে, সাইফের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন না করে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় এনসিটি পরিচালনা করবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে এনসিটির দীর্ঘমেয়াদি পরিচালনার জন্য দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে অপারেটর হিসেবে নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন নৌ উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, "ডিপি ওয়ার্ল্ড যদি অপারেটর হিসেবে নিযুক্ত হয়, তবে নির্দিষ্ট মেয়াদের চুক্তির ভিত্তিতে তারা কাজ করবে, যেমনটি তারা বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে করে থাকে। তবে এনসিটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছেই থাকবে।"
সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, "মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমাদের একটি সভা হয়। আমাদের বক্তব্য হলো, এনসিটি কিংবা চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম যেন এক মিনিটের জন্যও বন্ধ না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে যা যা প্রয়োজন আমরা করব।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের জনবল ব্যবহারের বিষয়ে এখনো কোনো লিখিত চুক্তি হয়নি। বিষয়টি আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে।"
এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর শ্রমিক দল (সাবেক সিবিএ)–এর প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, "নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত আরও আগেই নিতে পারত। গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ বিশেষায়িত ইকুইপমেন্টগুলো পরিচালনায় নির্ভর করতে হয় সাইফ পাওয়ারটেকের কর্মীদের ওপর। বন্দর কর্তৃপক্ষ যদি তাদের নিজস্ব কর্মীদের এসব যন্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ দিত, তাহলে এই সংকট সৃষ্টি হতো না।"
তিনি আরও বলেন, "তবে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনায় কার্যক্রম এগিয়ে নিতে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব।"
১৮ জুন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরপরই বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এনসিটি পরিচালনার প্রস্তুতি নেয়। বিভিন্ন বিভাগকে প্রস্তুত রাখতে একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ২৪ জুন ট্রাক্টর-ট্রেইলার ও প্রাইম মুভার ব্যবহারের জন্য ছয় মাসের টেন্ডার আহ্বান করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দরের স্টেকহোল্ডাররা বলছেন, বন্দর পরিচালনায় কে আছে তা বড় বিষয় নয়—অপারেশন যেন গতিশীল থাকে এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে কোনো ধরনের বিঘ্ন না ঘটে, সেটিই মূল বিবেচ্য।
এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
তবে বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, "নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বন্দর কর্তৃপক্ষ এনসিটি পরিচালনার সার্বিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। এনসিটির কার্যক্রম যেন বিঘ্নিত না হয়, সে পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা এগোচ্ছি।"
উল্লেখ্য, নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালের বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ১১ লাখ টিইইউ (টুয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট)। তবে বর্তমানে সেখানে বছরে প্রায় ১৩ লাখ টিইইউ হ্যান্ডলিং করা হয়। টার্মিনালটিতে চারটি জেটি রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে চারটি কনটেইনার জাহাজ ভিড়তে পারে। এখান থেকে চট্টগ্রাম বন্দর বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে।