সিলেটে উপদেষ্টাদের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ হয় বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্বে, যুবদল নেতা বহিষ্কার

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে সরকারের দুই উপদেষ্টার গাড়িবহর আটকে বিক্ষোভের ঘটনায় স্থানীয় বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের একাধিক নেতার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে যুবদলের একজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে, বাকিদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
শনিবার (১৪ জুন) সকালে জাফলং পর্যটন এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের ক্ষোভের মুখে পড়েন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
জাফলং থেকে ফেরার পথে গোয়াইনঘাটের বল্লাঘাট এলাকায় তাদের গাড়িবহর আটকে দেন বালু-পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা। উপদেষ্টাদের গাড়ি আটকে তারা বন্ধ থাকা জাফলংসহ সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো চালুর দাবি জানান। পরে পুলিশের সহায়তায় বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে সে জায়গা থেকে ফিরে আসেন দুই উপদেষ্টা।
ঘটনার ভিডিওতে স্থানীয় যুবদল, ছাত্রদল ও শ্রমিক দলের নেতাদের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজিজ উদ্দিন 'ভুয়া, ভুয়া' স্লোগান দিচ্ছেন।
এসময় আরও কয়েকজন ছাত্রদল, যুবদল ও শ্রমিক দলের নেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্রদলের সহসভাপতি সুমন শিকদার, জেলা ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক সোহেল আহমদ, উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি আবদুল জলিল, যুগ্ম সম্পাদক আবদুস সালাম, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রমজান মোল্লা এবং উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খান।
এদের মধ্যে জাহিদ খানকে বহিষ্কার করেছে যুবদল। দলটির কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম ভূঁইয়ার সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সিলেট জেলা যুবদলের সভাপতি মোমিনুল ইসলাম বলেন, উপদেষ্টাদের গাড়িবহর আটকে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় জাহিদকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এদিকে, উপদেষ্টাদের গাড়ি আটকে দেয়া প্রসঙ্গে ছাত্রদল নেতা আজির বলেন, 'আমি না, আমরা যা করেছি তা এলাকাবাসীর স্বার্থে করেছি।'
এ ঘটনার একটি ভিডিওতে আজিরকে বলতে দেখা গেছে, 'আমরা আশা করেছিলাম আজ তিনি [উপদেষ্টা রিজওয়ানা] ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে পাথর কোয়ারি খুলে দিয়ে শ্রমিকদের রুটি রুজির পথ খুলে দেবেন। কিন্তু কিছু দালাল চক্র উনাকে ভুলভাল বুঝিয়ে তিনি শ্রমিকদের পেটে লাথি মেরে চলে গেছেন। শ্রমিকদের একটাই দাবি, ভাত ও কাজের অধিকার। শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না করে উনি উনার গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু আমরা এই এলাকার পাঁচ লাখ শ্রমিক আন্দোলন করে যাব। যতদিন ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে জাফলং পাথর কোয়ারি খুলে না দেওয়া হবে, ততদিন।'
ছাত্রদল নেতাদের সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে সিলেট জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'ছাত্রদলের স্থানীয় কয়েকজন নেতা বিক্ষোভে জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিষয়টি কেন্দ্রীয় কমিটিকে জানানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।'
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর সরকার জাফলংকে 'পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)' ঘোষণা করে। এরপর ধাপে ধাপে পাথর উত্তোলনের ইজারা বন্ধ করা হয়। উন্মুক্ত শিলাস্তর, চুনাপাথর সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য জাতীয় স্বার্থে ২০১৬ সালে জাফলং-এর ২২ দশমিক ৫৯ একর এলাকাকে 'ভূতাত্ত্বিক ঐতিহ্য' হিসেবে ঘোষণা করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। ওই এলাকায় আন্তর্জাতিক মানের ভূতাত্ত্বিক জাদুঘর গড়ার পরিকল্পনাও জানানো হয়।
তবে গত বছরের ৫ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে ১ কোটি ঘনফুট পাথর লুট হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় সেখানে সেনা সদস্যরাও যেতে পারেননি। এরপর থেকে জাফলংয়ে বালু ও পাথর লুটপাট চলছে। পাশাপাশি পাথর কোয়ারি ইজারার দাবিও জানিয়ে আসছে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা।
শনিবার সকালে জাফলং পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'সিলেটের নান্দনিক ও নৈসর্গিক আবেদন আছে, এইরকম জায়গায় আমরা আর পাথর উত্তোলনে অনুমতি দিব না। এই জায়গা [জাফলং] পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। আমরা কথা বলেছি পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে—এইখানে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের বিকাশের মাধ্যমে যারা পাথর উত্তোলন করেন তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য।'
জাফলং এলাকায় অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনের ফলে পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানও। তিনি বলেন, 'অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে এই এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। আপাতত এখান থেকে আর পাথর উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হবে না। এখানে যে-সব ক্রাশার মেশিন রয়েছে, সেগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলো যদি সঠিকভাবে উন্নয়ন করা যায়, তাহলে এখান থেকে এমন রাজস্ব আসবে, যা লন্ডন থেকে আসা রেমিট্যান্সকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি পাথর তুলে পরিবেশ ধ্বংস করব, না কি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা করে পর্যটন বিকাশের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি করব।'