রোগীর রক্ত খোঁজার ভোগান্তি কমাতে ‘ওয়ান ব্লাড নেটওয়ার্ক’ চালু করছে সরকার

রোগীদের দ্রুত ও সহজে রক্তের ব্যবস্থা করতে এবং দেশে রক্তভিত্তিক ওষুধ উৎপাদনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার চালু করতে যাচ্ছে 'ওয়ান ব্লাড নেটওয়ার্ক'। পরীক্ষামূলকভাবে চালু হতে যাওয়া এই ব্যবস্থার মাধ্যমে রক্ত খোঁজার দুর্ভোগ কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহায়তায় গঠিত এই নেটওয়ার্কে থাকবে স্বেচ্ছাসেবী ডোনারদের একটি সমন্বিত ডাটাবেইজ, মোবাইল ব্লাড ভ্যানের মাধ্যমে রক্ত বিনিময়ের ব্যবস্থা এবং ঢাকাসহ পাঁচটি বিভাগীয় শহরে গঠিত হবে 'ন্যাশনাল ট্রান্সফিউশন সেন্টার হাব'।
এই উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক জানান, 'প্রাথমিকভাবে একটি সমন্বিত ডোনার [রক্তদাতা] ডাটাবেইজ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ইতোমধ্যেই তিন লাখ ডোনারের তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। এতে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে সাধারণ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীরাও ইউএসএসডি কোড, যেমন- 'স্টার' বা 'হ্যাশ' ডায়াল করে এলাকার প্রয়োজনীয় ব্লাড গ্রুপের ডোনার খুঁজে পেতে পারেন। ডোনার খুঁজে পাওয়ার পর এসএমএসের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হবে।'
এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)-এ স্থাপন করা হবে মোবাইল ব্লাড ভ্যান। রোগীর স্বজনরা সেখানে গিয়ে রক্ত বিনিময় করতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ, কারও যদি এ পজিটিভ রক্ত দরকার হয় এবং তার কাছে ও পজিটিভ রক্ত থাকে, তবে তিনি বিনিময়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় রক্ত সংগ্রহ করতে পারবেন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ওয়ান ব্লাড নেটওয়ার্ক চালু হলে মানুষের জন্য রক্ত পাওয়া সহজ হবে এবং দেশেই ব্লাড প্রোডাক্ট উৎপাদন সম্ভব হবে। এটি একটি বড় অর্জন হবে বাংলাদেশের জন্য।'
ঢাকা হবে কেন্দ্র ও চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী এবং খুলনায় স্থাপন করা হবে ন্যাশনাল ট্রান্সফিউশন সেন্টার হাব। সংগৃহীত রক্তের উপাদান যেমন ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা (এফএফপি) থেকে তৈরি করা হবে গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ—অ্যালবুমিন, ফ্যাক্টর-৮ ও ফ্যাক্টর-৯। এর ফলে বিদেশ থেকে এই ওষুধ আমদানির প্রয়োজন কমবে এবং কয়েক হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে হাসপাতাল বা ইনস্টিটিউটে অতিরিক্ত রক্ত সংরক্ষিত থাকলে সাধারণত ২৫ দিন পর সেগুলো ফেলে দেওয়া হয়।
ডা আশরাফুল হক বলেন, 'আমরা প্রচুর ব্লাড নষ্ট করি, সেগুলো নষ্ট না করে যদি অ্যালবুমিন, ফ্যাক্টর ৮ দেশের দেশেই উৎপাদন করা যায় তাহলে নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে পারবো। আর্থিকভাবে লাভবান হবো।'
রক্তের ব্যাগে থাকবে 'বারকোড'
রক্তের মান নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি ব্যাগে সংযুক্ত থাকবে 'বারকোড', যাতে থাকবে ডোনারের বয়স, রক্তের গ্রুপ ও মেয়াদসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য। স্মার্টফোন দিয়ে স্ক্যান করে যে কেউ জানতে পারবেন রক্তের ব্যবহার, মেয়াদ এবং এটি কার শরীরে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে রক্তের অপচয় ও অবৈধ বাণিজ্য ঠেকানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ঠরা।
দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ আসে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে, বাকিটা রোগীর স্বজন বা অপরিচিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়।
সবচেয়ে বেশি রক্তের প্রয়োজন পড়ে দুর্ঘটনা, একলামশিয়া ও প্রিএকলামশিয়া, সিজারিয়ান ডেলিভারি, ডায়ালাইসিস এবং থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে।
এই নেটওয়ার্কের আওতায় স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের রক্তদানে উৎসাহিত করার জন্য থাকবে চার মাসের মেয়াদি হেলথ কার্ড। এই কার্ড ব্যবহার করে তারা ও তাদের পরিবার সরকারি ও কিছু বেসরকারি হাসপাতালে নির্দিষ্ট কিছু রক্ত পরীক্ষা বিনামূল্যে করাতে পারবেন।