তাপমাত্রা কম, তবু গরমে এত অস্বস্তি কেন?

বরিশালে মঙ্গলবার দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে বাস্তবে এই তাপমাত্রার চেয়েও বেশি গরম অনুভব করেছেন সেখানকার মানুষ। অনেকের অভিমত, এর আগেও তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলেও এতটা অস্বস্তি হয়নি।
বরিশালের বাসিন্দা আহাদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আকাশ মেঘলা হোক বা রোদ, গরম সহ্য হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপর ঘামছি। এমনকি রাতে তাপমাত্রা কমছে না, অস্বস্তি থেকেই যাচ্ছে।'
শুধু বরিশাল নয়, রাজধানী ঢাকা সহ দেশের অনেক অঞ্চলে একই অবস্থা বিরাজ করছে। গত কয়েকদিন ধরেই দেশের অধিকাংশ এলাকায় অনুভূত তাপমাত্রা প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থার জন্য দায়ী অতিরিক্ত আর্দ্রতা, নগর এলাকার তাপ ধরে রাখার প্রবণতা এবং খারাপ বায়ুমান। যার ফলে মাঝারি মাত্রার তাপমাত্রাও অসহনীয় মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বর্তমানে ৪৯টি জেলায় মৃদু তাপপ্রবাহ বইছে। ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, খুলনা ও সিলেট বিভাগ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলায় এই গরম কিছুটা সময়ের জন্য অব্যাহত থাকতে পারে।
তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, এক থেকে দুই দিনের মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা কিছুটা কমে আসতে পারে এবং গরমের প্রকোপ হ্রাস পেতে পারে।
আবহাওয়াবিদ ড. মোহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে বর্ষা কম সক্রিয়। বাতাসের গতি কম, কিন্তু আর্দ্রতা অনেক বেশি। এ কারণে অনুভূত তাপমাত্রা প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
তিনি জানান, বর্ষাকালে আর্দ্রতা বেশি থাকে বলেই তখন অনুভূত তাপমাত্রা প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে ২ থেকে ৬ ডিগ্রি পর্যন্ত বেশি হয়। উপকূলীয় অঞ্চলে এই পার্থক্য আরও বেশি। ফলে তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম হলেও শরীরে অস্বস্তি এবং অতিরিক্ত ঘাম হয়।
তার ভাষ্যে, অনুভূত তাপমাত্রা ব্যক্তি, সময় ও পরিবেশ ভেদে পরিবর্তিত হয়। কেউ যদি ঘরের মধ্যে থাকে, সেখানে বাতাস চলাচল কেমন বা ঘরের ভেন্টিলেশন [বায়ু চলাচল] কী রকম—এসবের ওপর নির্ভর করে কতটা গরম লাগবে। একইভাবে শরীরে কী ধরনের কাপড় পরা আছে, তাও অনুভূতির ওপর প্রভাব ফেলে। তাই এই সময়ে ছায়াযুক্ত ও বাতাস চলাচল করে এমন স্থানে অবস্থান করলেই অস্বস্তি কিছুটা কম অনুভূত হবে।
বর্তমান গরমে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন নিম্নআয়ের মানুষজন। রিকশাচালক, ফুটপাতের হকার, টিনের ঘরে বসবাসকারী বস্তিবাসী—যাদের থাকার বা কাজ করার পরিবেশে ঠান্ডা বা ছায়া নেই। এ অবস্থায় শিশু ও বয়স্করা বেশি ঝুঁকির মুখে আছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের গ্রীষ্মে আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছায়। এতে শরীরের ঘাম বাষ্পীভূত হতে পারে না, ফলে শরীর স্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা হওয়ার সুযোগ পায় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয় এবং আর্দ্রতা থাকে ৮০ শতাংশ, তাহলে সেই পরিস্থিতিতে মানুষ ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো তাপমাত্রা অনুভব করে।
ঢাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পরিকল্পনার অভাব, গাছপালা ও জলাধার ধ্বংস করে কংক্রিট ও পিচ ঢালা সড়ক তৈরির কারণে নগর এলাকায় তাপমাত্রা আরও বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাতাসে ধুলাবালি, যানবাহনের ধোঁয়া এবং শিল্পকারখানার বর্জ্য জমে গিয়ে তাপ নিচের দিকে আটকে থাকে। এতে করে বাতাসের মান আরও খারাপ হয় এবং গরমের কষ্ট আরও তীব্র হয়।
এই অবস্থায় মানুষের সুস্থতা রক্ষায় কিছু নির্দেশনা দিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতি গরম দিনের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, যার জন্য প্রস্তুত থাকা জরুরি।
তারা বলেছে, এই সময় প্রচুর বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। রোদে কাজ করলে কিছুক্ষণ পরপর ছায়ায় গিয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। ঘরের পরিবেশ খোলামেলা এবং ঠান্ডা রাখতে হবে। একটানা পরিশ্রম করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
সতর্কতা হিসেবে তারা বলছে, কারও পায়ের চামড়া লাল হয়ে গেলে, মাথা ঘুরলে, বমি বমি ভাব দেখা দিলে, প্রস্রাব কমে গেলে বা রঙ পরিবর্তন হলে, ঘাম না হলে, চোখে ঝাপসা দেখলে, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বা হৃদস্পন্দন দ্রুত হলে এবং কেউ অস্বাভাবিক আচরণ করলে বা অজ্ঞান হয়ে গেলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে নীলফামারীতে, ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় ছিল ৩৬.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অনেক জায়গায় বৃষ্টি হলেও গরম কমছে না।
ড. আবুল কালাম মল্লিক জানান, বুধবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে পারে। এতে করে তাপমাত্রা কিছুটা কমে যাবে এবং যে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তা প্রশমিত হতে পারে। আগামী এক সপ্তাহ দেশের বেশির ভাগ জায়গায় প্রতিদিনই দু-এক পশলা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।