করিডোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত সংসদ থেকে আসতে হবে, জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে: তারেক

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, রাখাইনে প্রস্তাবিত মানবিক সহায়তা করিডোর নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিদেশী শক্তির চেয়ে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং এ ধরনের সিদ্ধান্ত সংসদ থেকে আসতে হবে।
তিনি বলেন, 'আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট—বিদেশীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সবার আগে দেশের জনগণের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান কিংবা অন্য কোনো দেশ নয়—সবার আগে বাংলাদেশ। এটিই হতে হবে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।'
তিনি বলেন, 'দেশের জনগণকে না জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি-না কিংবা নেওয়া উচিত কি-না এই মুহূর্তে সেই বিতর্ক আমি তুলতে চাই না। তবে দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ মনে করে, করিডোর দেওয়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের কাছ থেকে। সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্ট থেকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক বিশ্বের দেশগুলোতে এটাই নিয়ম, এটাই রীতি।'
বৃহস্পতিবার (১ মে) মে দিবস উপলক্ষে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির শ্রমিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল আয়োজিত এক সমাবেশে ভার্চুয়াল বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
মিয়ানমারের সংঘাত-বিধ্বস্ত রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
তারেক রহমান বলেন, 'অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে লিপ্ত মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে, অন্তর্বর্তী সরকার না-কি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িত এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার কিন্তু জনগণকে জানায়নি। এমনকি জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও কোনো ধরনের আলোচনার প্রয়োজনবোধ করেনি।'
তারেক রহমান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি অনির্দিষ্টকালের জন্য সমর্থন অব্যাহত রাখা যৌক্তিক নয়।
তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশে জনগণের ভোটে জনগণের চোখে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যেই বিএনপিসহ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তবে গণতন্ত্রকামী জনগণ মনে করে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি অনির্দিষ্টকালের জন্য সমর্থন অব্যাহত রাখা যৌক্তিক নয়।
তিনি আরও বলেন, পলাতক স্বৈরাচার যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ না পায়—এজন্যই জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি।
তারেক বলেন, 'ফ্যাসিস্ট কিংবা স্বৈরাচার হওয়ার মন্ত্র—দেশের সংবিধান কিংবা দেশের আইনে লেখা থাকে না। বরং সংবিধান ও আইন না মানার কারণেই ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়। একজন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী যখন থেকে নিজেকে কিংবা নিজেদেরকে একমাত্র অনিবার্য, অপরিহার্য মনে করে—জনগণের ওপর একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে শুরু করে, তখন থেকেই ফ্যাসিবাদের যাত্রা শুরু হয়।'
তিনি বলেন, কোনও ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর বিনা ভোটে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার সুপ্ত বাসনা যেন রাষ্ট্র ও সরকারকে ফ্যাসিবাদের প্রতি প্রলুব্ধ করতে না পারে—এজন্যই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জাতীয় সংসদ এবং জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
তারেক রহমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এ সরকারের একটি অংশ সংস্কার ও নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সুপরিকল্পিতভাবে বিরোধ উস্কে দিতে চায়।
তিনি বলেন, গণতন্ত্রকামী জনগণের মনে এ ধরনের বিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে।
তিনি আহ্বান জানান, 'স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার প্রস্তাবনা প্রণয়ন করুন। কোনও রাজনৈতিক দলের আপত্তি নেই। তবে পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তুত করুন। সুনির্দিষ্টভাবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণা করুন। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মপরিকল্পনায় পথনকশা গণতন্ত্রকামী জনগণের কাছে সুস্পষ্ট থাকলে জনমনে সন্দেহ, সংশয় কেটে যাবে।'
তারেক রহমান বলেন, দেশে এখন প্রতিনিয়ত সংস্কার নিয়ে শোরগোল হচ্ছে। গণমাধ্যমের খবর কিংবা টক শো—সবখানেই সংস্কার।
'কিন্তু এই কর্মযজ্ঞে কৃষক, শ্রমিকের কণ্ঠস্বর কোথায়? তারাই তো গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তারা কোথায়, কার কাছে তাদের সমস্যা বা সম্ভাবনার কথা তুলে ধরবে? কে তাদের প্রতিনিধি?'
বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা মনে করি—প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুঃখ, দুর্দশা, সমস্যা, সম্ভাবনার কথা যাতে রাষ্ট্র ও সরকারের কানে পৌঁছায়, সেজন্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, জাতীয় সংসদ ও নির্বাচিত সরকার দরকার।
তিনি বলেন, জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সরকারে সংস্কারের জন্য বাংলাদেশের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বিএনপি ২০২৩ সালেই ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল।
'রাষ্ট্র, রাজনীতির গুণগত সংস্কারের জন্য যেমন সংস্কার প্রয়োজন, তেমনি জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করতে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন নির্বাচন। বিএনপি মনে করে—সংস্কার ও নির্বাচন উভয়ই প্রয়োজন,' বলেন তিনি।
একমত হওয়া সংস্কার বাস্তবায়ন করে দ্রুত নির্বাচন দিন: ফখরুল
মে দিবসের সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'যেসব সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে—সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে নির্বাচন দিন। সেগুলো নিয়ে জুলাই চার্টার করে—পার্লামেন্টকে ফাংশনাল করব।'
তিনি বলেন, আজ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর।
'অন্তর্বর্তী সরকারকে বলছি—সংস্কার দ্রুত ত্বরান্বিত করুন। প্রেসিডেন্ট জিয়া বাকশাল থেকে সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণ করেছিলেন। মিডিয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সুতরাং সংস্কার আমাদের দাবি। সংস্কার আমাদের সন্তান।'
তিনি বলেন, আজ আমরা রাজনৈতিকভাবে অস্বাভাবিকতার মধ্যে আছি। আমরা ফ্যাসিস্টের পতন ঘটিয়েছি, কিন্তু এখনো ভোটের মাধ্যমে পার্লামেন্ট গঠন করতে পারিনি।
মে দিবস উদযাপন নিয়ে ফখরুল বলেন, 'এই সভ্যতা, এই পৃথিবী, বড় বড় অট্টালিকা—সবকিছুর মূলে শ্রমিকদের রক্ত, ঘামের অবদান রয়েছে। আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত সেই দিবসই আজ পালিত হচ্ছে।'
তিনি বলেন, মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে বঞ্চিত শ্রেণি হচ্ছে শ্রমিক সমাজ। তারা গোটা সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখে।
'উৎপাদন প্রক্রিয়ার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু শ্রমিক সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো হয়নি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এসব উপলব্ধি করে গার্মেন্টস চালু করেছিলেন। শ্রমিক রপ্তানির ব্যবস্থা করেছিলেন। গার্মেন্টসসহ নানা শিল্প গড়ে তুলেছিলেন। শ্রমিকদের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও করেছিলেন। দেশনেত্রী খালেদা জিয়া শ্রম আদালত গঠন করেছিলেন।'