জনবল সংকটে ধুঁকছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, দশক ধরে ফাঁকা গুরুত্বপূর্ণ পদ

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জনবল সংকটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে দেশের আয়তনে বৃহত্তম গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন (জিসিসি)। মেয়রশূন্য এ সিটি কর্পোরেশনে প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ ৯টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। ফলে প্রায় অর্ধকোটি মানুষের নাগরিক সেবা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
জিসিসি কর্তৃপক্ষ বলছে, শূন্য পদে জনবল পদায়নের জন্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। তবে এখনো নিয়োগ বিধি অনুমোদন না হওয়ায় নতুন জনবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি গঠিত হয় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন। সাবেক গাজীপুর ও টঙ্গী পৌরসভাসহ মোট ৩২৯.৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত এই কর্পোরেশনে বর্তমানে ৬০ লাখের বেশি মানুষ বাস করছেন। প্রতিষ্ঠাকালে দুই পৌরসভার জনবল দিয়েই যাত্রা শুরু হয়। জনবল কাঠামো ও নিয়োগ বিধি না থাকায় পরবর্তী সময়ে স্থায়ীভাবে জনবল নিয়োগ সম্ভব হয়নি।
সূত্র আরও জানায়, কর্পোরেশন গঠনের ১০ বছর পর ২০২২ সালে জিসিসির জনবল কাঠামো অনুমোদন করা হলেও এখন পর্যন্ত নিয়োগ বিধি অনুমোদিত হয়নি। ফলে নতুন নিয়োগ বা পদোন্নতি দেওয়া যাচ্ছে না। প্রায় ১২ বছর ধরে পুরোনো পৌরসভার জনবল দিয়েই চলছে বৃহৎ এ সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জনবল সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নগরবাসী। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, মান নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা, দায়িত্বে স্থবিরতা এসবই নগরজীবনে ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, শূন্য পদে জনবল পদায়ন করলে নাগরিক সেবা কার্যক্রমে গতি ফিরবে।
সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জিসিসির সকল উন্নয়ন ও নির্মাণকাজের মূল দায়িত্ব এ বিভাগ বহন করে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে প্রধান প্রকৌশলী ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদ শূন্য রয়েছে। জিসিসির আটটি অঞ্চলে মাত্র ২ জন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও ৮ জন নির্বাহী প্রকৌশলী দায়িত্ব পালন করছেন—তাও বেশিরভাগই অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে।
এছাড়া সচিব, প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জনসংযোগ কর্মকর্তা, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, প্রোগ্রামার এবং ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ৮টি পদ শূন্য। এসব পদে নিয়োগ না থাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
নগরবাসীর অভিযোগ, মেয়র না থাকায় নেতৃত্বশূন্যতায় কার্যত অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে জিসিসি। শিল্প-কারখানাসমৃদ্ধ গাজীপুর শহরে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে সিটি কর্পোরেশন। জনবল সংকট ও প্রশাসনিক অচলাবস্থা মিলিয়ে এটি একটি স্থবির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
গাজীপুর নাগরিক ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন বলেন, ''পৌরসভা থেকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হলেও এখানকার নাগরিক সুবিধা এখনও পৌরসভার আমলেই রয়ে গেছে। মেয়র নেই, দক্ষ কর্মকর্তা নেই—সব মিলিয়ে জনদুর্ভোগ বেড়েছে।''
তিনি বলেন, ''গত এক যুগে গাজীপুরে নাগরিক সেবা বাড়েনি। তিনটি নির্বাচনে আমরা আশাবাদী হয়ে ভোট দিয়েছি, কিন্তু কেউ মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, নেতৃত্ব ও জনবল সংকট নগরীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে।''
জালাল উদ্দিন আরও বলেন, ''সেবার জন্য নগর ভবনে গেলেই শুনতে হয়—লোক নেই। তাহলে এত বড় সিটি কর্পোরেশন গঠন করে নাগরিকদের বাড়তি কর ও হয়রানির বোঝা কেন চাপানো হলো? আমরা দ্রুত শূন্যপদ পূরণ ও নিয়োগ বিধি অনুমোদনের দাবি জানাই।''
গাজীপুর জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক এ এন এম মুনীর হোসাইন মোল্লা বলেন, ''১২ বছরেও নাগরিক সুবিধা বাড়েনি। রাস্তা-ঘাট ভাঙাচোরা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভঙ্গুর, ড্রেনেজ ব্যবস্থায় নাজুক অবস্থা। সামান্য বৃষ্টিতেই পানিতে ডুবে যায় সড়ক—এমনকি ঘরবাড়িও। কোনো দিকেই সুশাসনের ছাপ নেই।''
তিনি বলেন, ''জিসিসি কার্যত একটি অচল প্রতিষ্ঠান। নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণে এটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। দ্রুত পদায়ন, নিয়োগ ও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়।''
জিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (যুগ্ম সচিব) আব্দুল লতিফ খান বলেন, ''গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন হলেও আমরা এখনও পৌরসভার জনবল দিয়েই কাজ চালাচ্ছি। জনবল সংকট আছে। শূন্যপদ পূরণ ও নতুন জনবল নিয়োগ হলে সেবার মান বাড়বে।''
জিসিসির প্রশাসক ও ঢাকা বিভাগের কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ''আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে কিছু উদ্যোগ নিয়েছি এবং নাগরিকবান্ধব কর্মসূচিও চালু করেছি। তবে জনবল না থাকায় বাস্তবায়নে বিঘ্ন ঘটছে।''
তিনি জানান, ''গুরুত্বপূর্ণ পদে জনবল নিয়োগ এবং পদোন্নতির জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ বিধিমালা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি। আশা করছি, দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে।''