আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত জাতীয় ঐকমত্য তৈরি সম্ভব: আলী রীয়াজ

সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় ঐকমত তৈরি করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
শনিবার সকালে জাতীয় সংসদের এলডি হলে খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বৈঠক শুরুর আগে তিনি এ কথা বলেন।
আলী রীয়াজ বলেন, আপনারা মতামতগুলোর অনেক ক্ষেত্রে একমত পোষণ করেছেন, অনেক ক্ষেত্রে আপনাদের কিছু ভিন্নমত আছে, বক্তব্য আছে, সেগুলো আমরা শুনব। আমরা মনে করি আলাপ আলোচনার মাধ্য দিয়ে আমরা একটা জাতীয় ঐকমত তৈরি করতে পারব'।
তিনি আরও বলেন, অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা এই আলোচনা শুরু করেছি। দীর্ঘ সময় দেওয়া সম্ভব হয়নি, তবে আপনারা আন্তরিকভাবে মতামত দিয়েছেন। এসব মতামতের ভিত্তিতেই আমাদের আলোচনা এগিয়ে যাবে।
তিনি জানান, শুধু খেলাফত মজলিশ নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও আলোচনা চলবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছানোই লক্ষ্য।
সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে। তার ধারাবাহিকতায় আজ দ্বিতীয়দিন আলোচনায় অংশ নেয় দুটি রাজনৈতিক দল- খেলাফত মজলিশ ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি।
বৈঠক শেষে খেলাফত মজলিশের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের জানান, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ১৪০টিতে আমরা একমত হয়েছি। ১০টিতে মতৈক্য হয়নি, আর ১৫টিতে আংশিকভাবে সম্মত হয়েছি।
তিনি বলেন, 'আমরা মনে করি প্রয়োজনীয় সংস্কার দশ মাসে করা সম্ভব। এটা অধ্যাদেশ জারি করে করা উচিত। বিধ্যমান সংস্কার নির্বাচনের আগেই সম্ভব'।
সংস্কার করতে হলে আরও আলোচনার দরকার আছে জানিয়ে আব্দুল কাদের বলেন, 'দ্বিমতের বিষয়ে উভয় পক্ষ আলোচনা করেছি। আমরা চেষ্টা করেছি, উনারা চেষ্টা করেছেন। এক পর্যায়ে এসে আলোচনা ড্র হয়েছে। আরও সময় লাগবে। কিছু বিষয়ে উনারা বলেছেন বিবেচনা করব, আমরাও বলেছি কিছু বিষয়ে আমরাও বিবেচনা করব। কৌশলগত কিছু বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্য হলে আমরা আপত্তি করব না'।
প্রস্তাবিত বহুত্যবাদ বাদ দেওয়ার দাবি করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'সংবিধানে মহান আল্লার প্রতি আস্থা বিশ্বাস রাখতে হবে। বহুত্যবাদ (সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব) বাদ দতে হবে। আমরা বলেছি গণতন্ত্রই এনাফ, উনারা অনেক যুক্তি দিয়েছিল। আমরা বলেছি গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদায় থাকলে সমাজে কোনো ধরনের বিভেদ থাকে না। বহুত্ববাদের কোনো প্রয়োজন নাই।'
খেলাফত মজলিশ গণপরিষদের পক্ষে নয় বলে জানিয়েছেন দলের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের। তিনি বলেন, 'আমরা ৪০০ আসনে নারীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছি। সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর রাখার পক্ষে রয়েছি। এছাড়া, উচ্চকক্ষে (সিনেটে) সংখ্যালঘুদের এক শতাংশ ভোটের ভিত্তিতে আসন বণ্টনের অনুরোধ জানিয়েছি।'
তিনি আরও বলেন, সংবিধান সংশোধন অধ্যাদেশের মাধ্যমে করা সম্ভব, তবে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের মতামত নেওয়া যেতে পারে। গণপরিষদের প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়ে তিনি বলেন, 'রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়ে একটি বোর্ড থাকা উচিত। ব্যক্তিকে ক্ষমা দেওয়ার কোনো অধিকার দেয়া উচিৎ না। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি'।
ইসলামবিরোধী কোনো আইন করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ইসলামের স্পষ্ট বিরোধী কোনো আইন করা যাবে না, তা সংবিধানে বিধান থাকতে হবে। এটা সামাজিক ধর্মীয় স্থিতিশীলতা রাখার জন্য। এখানে ধর্ম বিরোধী আইন করা হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়'।
'আওয়ামী লীগ নির্বাচন করার সময় বলত কোরআন সুন্নাহ বিরোধী আইন করা হবে না। এটা সত্তরে বলছিল, গত নির্বাচনেও বলছিল। এটা তারা বরাবরই বলে, কিন্তু অনুশীলন করে না', যোগ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'ফ্যসিবাদ ও তাদের দোষর যারা, আগামী নির্বাচনে তাদের আসার সুযোগ নাই। তাদের বিচার করতে হবে। বিচারের পরে কেউ নিরপরাধ প্রমানিত হয়, তখন আসতে পারে। এই মূহুর্তে কোনো সুযোগ নেই। অনেকের মত আমরাও আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার বিষয়ে রাজি না। কারণ তারা খুন করে মানুষ মারার বিষয়ে ক্ষমা চায়নি'।
এদিকে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান জানান, তারা ১৪৭টি সুপারিশে একমত হয়েছেন, সাতটিতে মতপার্থক্য রয়েছে এবং ১২টিতে আংশিকভাবে সম্মত হয়েছেন।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের পক্ষে মত দিলেও তার দল দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করার বিপক্ষে, কারণ এতে 'নানা সমস্যা তৈরি হবে'। এছাড়া জেলা পরিষদ কার্যকর করার প্রস্তাবও তারা দিয়েছেন।
এছাড়া স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদে মেম্বারদের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচনের পরিবর্তে, আগের নিয়মে সরাসরি ভোটে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মতামত জানিয়েছি যে একই ব্যক্তি দুইবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কিন্তু পরপর দুইবার রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের যাবার পাঁচ বছর পর একজন ব্যক্তি নির্বাচনে যাবার উপযুক্ত হবেন এমন বিধান করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার প্রথমদিন বৃহস্পতিবার লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সঙ্গে আলোচনা হয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত বৃহস্পতিবার থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে।
কমিশন ইতোমধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার বিষয়ে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ৩৮টি রাজনৈতিক দলকে ১৩ মার্চের মধ্যে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হলেও অর্ধেক দল এখনো মতামত দেয়নি।
এখন পর্যন্ত ১৫টি দল মতামত জমা দিয়েছে। দলগুলো হলো- লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, খেলাফত মজলিশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, জাকের পার্টি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম ও 'আম জনতার দল', রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ও নাগরিক ঐক্য।