সংকটে থাকা ৫ ব্যাংকের গ্রাহকরা ডিসেম্বরেই পাবেন সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা, তবে খুলতে হবে নতুন অ্যাকাউন্ট
শরিয়াভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকের সমন্বিত প্রতিষ্ঠান 'সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক'-এর গ্রাহকরা বীমা তহবিল (ইনসুরেন্স ফান্ড) থেকে তাদের আমানতের দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত পাবেন চলতি ডিসেম্বরের মধ্যেই। তবে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের নামে নতুন অ্যকাউন্টে এ টাকা ফেরত দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, এক্সিম এবং ইউনিয়ন ব্যাংক—এই পাঁচ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক একীভূত হয়ে গঠিত সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে গত ২ ডিসেম্বর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক রেজ্যুলিউশন ডিপার্টমেন্টের (বিআরডি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে নতুন ব্যাংকের অধীনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে অর্থ ছাড় করেছে। তবে অর্থ প্রদান প্রক্রিয়ায় তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
তিনি বলেন, "প্রথমত, ব্যাংকের নিজস্ব ডেটা সফটওয়্যার তৈরি করা; গ্রাহকদের আমানত ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ভুল গ্রাহকদের টাকা ফেরত না দেওয়া হয়। এছাড়া, নতুন ব্যাংকের অধীনে আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলে ওই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেই অর্থ প্রদান নিশ্চিত করা।"
এদিকে মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আয়ুব মিয়ার বৈঠক হয়। বৈঠকে একীভূতকরণ স্কিমের অগ্রগতি, আমানতকারীদের অর্থ ফেরত প্রক্রিয়া এবং সংযুক্ত ব্যাংকগুলোর বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকের চেয়ারম্যান একীভূতকরণ স্কিমের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চান। গভর্নর কমিটিকে জানান যে বিভিন্ন টিমের মাধ্যমে কাজ এগিয়ে চলছে।
গভর্নর বিশেষত এক্সিম ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
বৈঠকে জানানো হয়, নতুন ব্যাংকের চেয়ারম্যান আইটি অবকাঠামোর প্রস্তুতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। ডেপুটি গভর্নর বলেন, দীর্ঘমেয়াদী আইটি একীভূতকরণে সময় লাগবে। আপাতত অবকাঠামো ভাড়ায় নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে প্রায় তিন বছর লাগতে পারে বলে গভর্নর জানান।
বৈঠকে গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর, নতুন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ফিন্যান্স ও এফআইডির দুই পরিচালক, বিআরডির নির্বাহী পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আয়ুব মিয়া টিবিএসকে বলেন, "ইনসুরেন্স ফান্ডের টাকা ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। যেহেতু গ্রাহকদের নতুন ব্যাংকের অধীনেই অর্থ প্রদান হবে, তাই সবার নামে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। পাঁচ ব্যাংকের পুরোনো অ্যাকাউন্টসমূহও একীভূত করতে হবে এবং ব্রাঞ্চভিত্তিক অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এসব কারণে সময় লাগছে। তবুও ডিসেম্বরের মধ্যেই গ্রাহকরা টাকা পেয়ে যাবেন বলে আশা করি।"
তিনি আরও বলেন, "আগামী সপ্তাহে বোর্ড মিটিং হবে। এছাড়া চলতি মাসেই নতুন এমডি নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এ নিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়েছে।"
কীভাবে টাকা পাবেন
গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া কী হবে এবং কারা কীভাবে টাকা তুলতে পারবেন, তা নিয়ে একটি স্কিম প্রস্তুত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্কিম চূড়ান্ত হওয়ার পরই তা প্রকাশ করা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র বলছে, যাদের হিসাবে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত রয়েছে, তারা চাইলে পুরো টাকা তুলতে পারবেন। আর যাদের হিসাবে দুই লাখ টাকার বেশি রয়েছে, তারা আপাতত সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পাবেন। বাকি টাকার বিষয়ে পরে নীতিমালা নির্ধারণ করা হবে এবং ওই অংশে নতুনভাবে মুনাফার হার ঠিক করা হবে।
অর্থাৎ, পাঁচ ব্যাংকের প্রায় ৭৫ লাখ আমানতকারীর সবাই তাৎক্ষণিকভাবে পুরো টাকা পাচ্ছেন না। আপাতত দুই লাখ টাকা পর্যন্ত তোলা যাবে, এরপর বাকি অংশ উত্তোলনের সুযোগ পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে। ছোট আমানতকারীদের জরুরি প্রয়োজন মোকাবিলায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
টাকা পাওয়ার নিয়ম
গ্রাহকদের টাকা পেতে কিছু শর্ত মানতে হবে।
একজন নাগরিকের নামে একই ব্যাংকে একাধিক হিসাব থাকলে শুধুমাত্র একটি হিসাবের বিপরীতে টাকা পাওয়া যাবে। এ জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে হিসাব থাকতে হবে। বৈধ এনআইডি দিয়ে খোলা হিসাবধারীরাই টাকা তুলতে পারবেন।
একজনের পাঁচ ব্যাংকে পাঁচটি ভিন্ন হিসাব থাকলে প্রতিটি ব্যাংক থেকে আলাদাভাবে টাকা পাওয়া যাবে। তবে কোনো হিসাবের বিপরীতে ঋণ থাকলে আপাতত টাকা পাওয়া যাবে না। ঋণ সমন্বয় শেষে ফেরতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে এবং ওই অংশে সুদের হার নতুন করে ঠিক হবে।
খরচ ১২ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে মোট প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা লাগবে। এই অর্থ আসবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের 'ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স স্কিম' থেকে।
একীভূত সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দেবে ২০ হাজার কোটি টাকা, আর বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা গ্রাহকের আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর করে পূরণ করা হবে। ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ৪০ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে সরকারের বরাদ্দ ২০ হাজার কোটি এবং ইন্স্যুরেন্স ফান্ডের টাকা নতুন ব্যাংকের হিসাবে ছাড় হয়েছে।
রাজধানীর মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনে নতুন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় চালু হয়েছে। চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দিয়েছে সরকার। পর্ষদের সদস্য হিসেবে সরকারের সাবেক ও বর্তমান আমলাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে পর্ষদকে আরও শক্তিশালী করা হবে।
