এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাম থেকে তোলা আমানত যাচ্ছে শহরাঞ্চলের ঋণে
 
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চল থেকে আমানত সংগ্রহ বেশি হলেও ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সেই অর্থের সিংহভাগ শহরাঞ্চলে বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো। ফলে গ্রামের ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পাচ্ছেন কম।
এজেন্ট ব্যাংকিং নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জুন মাসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গত এক বছরে গ্রামাঞ্চল থেকে আমানত বেড়েছে ৪ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা বা ১৪.৮ শতাংশ। এর বিপরীতে ওই অঞ্চলে ঋণ বিতরণ বেড়েছে মাত্র ৮০ কোটি টাকা বা ১.২ শতাংশ।
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মোট 'ডিপোজিট আউটস্ট্যান্ডিং' দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা, কিন্তু ঋণ বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।
কিন্তু শহরাঞ্চলে চিত্রটা ঠিক উল্টো। একই ১২ মাসে ওই অঞ্চলে আমানত বেড়েছে মাত্র ৬৫১ কোটি টাকা, কিন্তু ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা—যা আমানত প্রবৃদ্ধির দ্বিগুণেরও বেশি।
শহরাঞ্চলে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৫৪ শতাংশ, যা গ্রামাঞ্চলের ঋণ প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে প্রায় ৪৫ গুণ বেশি।
জুন পর্যন্ত শহরাঞ্চলে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানত ছিল ৭ বানার ৮১০ কোটি টাকা, আর লোন আউটস্ট্যান্ডিং ছিল ৫ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা।
গ্রামের ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের ওপর কম নির্ভরশীল কেন
তবে ব্যাংকাররা বলছেন, এই ভারসাম্যহীনতার কারণ ঋণের সুযোগ কম থাকা নয়, বরং গ্রামীণ মানুষের সহজ ব্যাংকিং পদ্ধতির প্রতি ঝোঁক বেশি।
এই ব্যবধানের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ব্যাংকে গ্রামাঞ্চল থেকে বেশি আমানত আসবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে ব্যাংক থেকে ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কম। কারণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়, ঋণ অনুমোদন হওয়ার সময়ও বেশি।'
'তারা কিছুটা বেশি সুদ দিয়ে হলেও ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) থেকে ঋণ নিচ্ছেন, কারণ সেখানে কাগজপত্রের প্রয়োজন কম এবং অল্প সময়েই ঋণ অনুমোদন হয়ে যায়,' বলেন তিনি।
এর আগে জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, এমএফআইগুলো শিগগিরই বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কারণ তাদেরকে এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) ও আসন্ন ডিজিটাল ব্যাংকের মতো ক্রমবর্ধমান আর্থিক পরিষেবাগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জায়তুন বিজনেস সলিউশনসের চেয়ারম্যান মো. আরফান আলীও মনে করেন, ঋণ প্রক্রিয়াকরণের অদক্ষতা গ্রামীণ ঋণগ্রহীতাদের নিরুৎসাহিত করে, কারণ তাদের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
'তাছাড়া ঋণের পরিমাণ ১ লাখ হোক আর ১০ কোটি টাকা হোক, ডকুমেন্টেশন রিকোয়ারমেন্ট প্রায়া একই। গ্রামের লোকজন এত কাগজপত্র জোগাড় করতে পারে না,' বলেন তিনি।
আরফান আলী আরও বলেন, গ্রামে ঋণ বিতরণের পরিচালন ব্যয় বেশি। 'এ কারণে গ্রামে ঋণ দেওয়া ব্যাংকের জন্য খুব বেশি লাভজনক হয় না। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে ঋণ বিতরণ করার জন্য দেশের এজেন্ট ব্যাংকিং সিস্টেম খুব একটা প্রস্তুতও না।'
প্রযুক্তিই উত্তরণের পথ
ব্যাংকাররা মনে করেন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও এজেন্টদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সাহায্যে গ্রামীণ এলাকায় ঋণ বিতরণ বাড়ানো সম্ভব।
আরফান আলী বলেন, 'প্রথমত, ব্যাংকগুলো এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে ঋণদান প্রক্রিয়া উন্নত করতে পারে। কেওয়াইসি-সহ অনেক কাজই এজেন্টদের মাধ্যমে করানো যেতে পারে। এতে একদিকে ব্যাংকের খরচ কমবে, অন্যদিকে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ উপকৃত হবে।
'দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা গ্রাহকদের অনবোর্ড করার মতো যথেষ্ট প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এখনও বেশিরভাগ ব্যাংকের নেই। তারা এখনো মান্ধাতার আমলের নিয়ম অনুসরণ করে। এখানে অবশ্যই ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
'তৃতীয়ত, এজেন্ট ব্যাংকিং ডেভেলপমেন্ট করার জন্য অনেক বিনিয়োগ ও অবকাঠামো নির্মাণ করা প্রয়োজন। এই কাজগুলো হলে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লোন বিতরণ একসম আমানতকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রাখে।'
সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও জোর দিয়ে বলেন, 'এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চলে ঋণ বাড়াতে হলে ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই প্রযুক্তির উন্নয়ন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।'

 
             
 
 
 
 
