চড়া শুল্ক ও চাহিদার পতনে গাড়ি আমদানি কমেছে, সরকারের রাজস্ব আয়েও বড় ধাক্কা

অর্থনীতির গতিমন্থরতার কারণে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানি কমে যাওয়ায় দেশের এর বাজার বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে গেছে। এই মন্দার পেছনে চড়া শুল্ক, ভোক্তাদের চাহিদা কমে যাওয়া, দীর্ঘস্থায়ী ডলার সংকট ও আমদানি নিষেধাজ্ঞার মতো একাধিক কারণ রয়েছে।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর (বারভিডা) তথ্য অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গাড়ি আমদানি হয়েছে ২১ হাজার ৩৩৭টি, যেখানে আগের অর্থবছরে আমদানি ছিল ২১ হাজার ৫১৯টি। তবে এই আমদানি থেকে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের পতন ঘটেছে। গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায় ৬ শতাংশের বেশি কমে ৩ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ৪৫৩ কোটি টাকা কম।
এই খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব চ্যালেঞ্জগুলো সরাসরি বিক্রির ওপর প্রভাব ফেলেছে। চট্টগ্রামের কার বাজার-এর স্বত্বাধিকারী মাসুদ আলম টিবিএসকে বলেন, 'আগে শোরুমগুলোতে মাসে গড়ে ১৫-২০টি গাড়ি বিক্রি হতো; এখন সেই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।'
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে ২০২২ সালের শুরু থেকে সরকার গাড়িসহ অন্যান্য বিলাসপণ্য আমদানিতে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা এই পরিস্থিতির একটি বড় কারণ। এই পদক্ষেপের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান কর ও অগ্রিম আয়কর (এআইটি) গাড়ি আমদানিকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলেছে। সর্বশেষ বাজেটে গাড়ি আমদানিতে এআইটি ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে।
বারভিডার সভাপতি আব্দুল হক এই খাতের দ্বিমুখী চাপের কথা তুলে ধরে বলেন, 'গাড়ি আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণেই এখন গাড়ি আমদানি কমছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মানুষের হাতে এখন টাকাপয়সা কম—যে কারণে বাজারে গাড়ির চাহিদা কমেছে। তাই আমদানিকারকরাও গাড়ি আমদানি কিছুটা কমিয়ে দিয়েছেন।'
'অন্যদিকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির প্রধান উৎস জাপানেই এখন পাঁচ বছরের কম সময় ব্যবহৃত গাড়ির চাহিদা তৈরি হয়েছে। ওই দেশেই এখন অনেকে এসব গাড়ি কিনে ব্যবহার করেন। তাই জাপানে গাড়ির বুকিং রেট বেড়েছে,' বলেন তিনি।
জাপানের তথ্য বলছে, দেশটিতে পাঁচ বছরের কম পুরোনো ব্যবহৃত গাড়ির চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। ফলে দামও বেড়ে গেছে, যা বাংলাদেশি আমদানিকারকদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে গাড়ি সংগ্রহ করা আরও কঠিন করে তুলেছে।
গত চার অর্থবছরের আমদানির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ হাজার ১৫৪টি গাড়ি আমদানি থেকে সরকার রাজস্ব আয় করেছে ৪ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৯ হাজার ৮০৩টি আমদানি থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয় ৩ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২১ হাজার ৫১৯টি গাড়ি আমদানি থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয় ৪ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২১ হাজার ৩৩৭টি গাড়ি আমদানি থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ৩ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা।
রিকন্ডিশন্ড গাড়ির খাত দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রাক্কলন অনুসারে, এ খাতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।
বাংলাদেশে মোট আমদানি করা গাড়ির প্রায় ৭৫ শতাংশ রিকন্ডিশন্ড, বাকি ২৫ শতাংশ সম্পূর্ণ নতুন। বর্তমানে দেশের ৬০ শতাংশ গাড়ি আমদানি করা হয় মোংলা বন্দর দিয়ে; বাকি ৪০ শতাংশ হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে।
বারভিডার সাবেক সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডন বলেন, এই খাতের পুনরুদ্ধার ধীর হতে পারে। 'ডলার সংকটসহ নানা প্রতিকূলতায় গাড়ির ব্যবসা ভয়াবহ সময় অতিক্রম করেছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি, এলসি জটিলতায় ধারাবাহিকভাবে কমছে গাড়ি আমদানি। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে,' বলেন তিনি।
গাড়ির ব্যবসায় মন্দার পেছনে ব্যাংকঋণ পেতে জটিলতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সুদহার বৃদ্ধিকেও দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আগে গাড়ির জন্য যেভাবে সহজে ব্যাংকঋণ পাওয়া যেত এখন সেটি পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকঋণ পেলেও সুদহার আগের চেয়ে বেশি—যা সম্ভাব্য ক্রেতাদের নিরুৎসাহিত করছে।
এই খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে আমদানিকারকরা সরকারের প্রতি বিধিনিষেধ শিথিল করার এবং সাত বছর পর্যন্ত পুরোনো রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানির অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানান। তারা মনে করেন, এই নীতিগত পরিবর্তন ব্যয় কমাতে ও গাড়ির সরবরাহ বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।