নতুন মুদ্রানীতিতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, অপরিবর্তিত রাখছে নীতি সুদহার

বাংলাদেশ ব্যাংক আজ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য মুদ্রানীতি বা মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্ট (এমপিএস) প্রকাশ করতে যাচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগের অর্ধবার্ষিকের ৯.৮ শতাংশ থেকে অনেকটা কমিয়ে ৭.২ শতাংশ করা হচ্ছে।
একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি আরও কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার (পলিসি রেট) ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদে ব্যাংকের একজন বোর্ড সদস্য গতকাল টিবিএসকে জানান, বুধবার অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড সভায় এই সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুমোদন পেয়েছে।
এই সংশোধিত পূর্বাভাস এমন এক সময়ে এল, যখন চলতি বছরের জুনে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬.৪০ শতাংশে নেমে এসেছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। গত কয়েক মাস ধরেই এই প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে রয়েছে। ওই বোর্ড সদস্য বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে পুরো ২০২৫২৬ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতের সামগ্রিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে পৌঁছাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আজ বিকেল ৩টায় ২০২৫ সালের জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদের জন্য নতুন এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন।
নীতি সুদহার ও মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, গভর্নর মনসুরের আগের ঘোষণা অনুযায়ীই নীতি সুদহার না বদলানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশের নিচে না নামলে নীতি সুদহার কমানো হবে না।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ১১.৬৬ শতাংশে উঠে যাওয়ার পর চলতি বছরের জুনে ৮.৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। মূল্যস্ফীতি কমে গত জুনে ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়েছে। তবুও মুূল্যস্ফীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার ওপরেই রয়েছে।
তবে এই হ্রাস অন্যান্য নিয়ামকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির কার্যকারিতার দিকেওনির্দেশ করে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে গড় মূল্যস্ফীতি ৬.৫০ শতাংশ ও প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
আরেকজন বোর্ড সদস্য জানান, সভায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একার পক্ষে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমবে না। খাদ্য মূল্যস্ফীতির একটা বড় অংশই হয় চালের দাম বাড়ার কারণে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সরকারকে প্রয়োজন অনুযায়ী চাল আমদানি করে পর্যাপ্ত মজুত রাখার কথা বলা হবে।
বর্তমান নীতি সুদহার
বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ গত বছরের ২২ অক্টোবর নীতি সুদহার বা রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ সশতাংশ নির্ধারণ করে। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ধক রেখে রেপোর বিপরীতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়; তার ওপর এই রেপো রেট প্রযোজ্য হয়।
নতুন মুদ্রানীতিতে ব্যাংকগুলোর জরুরি প্রয়োজনে নেওয়া ঋণের সুদহার হিসেবে স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) রেট ১১.৫০ শতাংশে অপরিবর্তিত থাকবে। আন্তঃব্যাংক কলমানি বাজারকে উৎসাহিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ১৫ জুলাই স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৮ সশতাংশ করেছে। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে টাকা রাখার ক্ষেত্রে এ সুদহার প্রযোজ্য হয়।
ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কতটা সম্ভব?
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
প্রতিকূল ব্যবসার পরিবেশ, জ্বালানি সরবরাহ ঠিকমতো না থাকা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতা এবং স্থবির উৎপাদন ও বিনিয়োগসহ সার্বিকভাবে মন্থর অর্থনীতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বাভাস বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম দেখছেন তিনি।
তিনি বলেন, 'বেসরকারি খাতে ঋণ তখনই বাড়ে, যখন দেশের বিনিয়োগ বা উৎপাদন বাড়ে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি কিছুটা ডিপ্রেসড অবস্থায় আছে। অর্থনীতির বিভিন্ন ইন্ডিকেটর অনুযায়ী, দেশের উৎপাদন বা বিনিয়োগ স্বাভাবিক গতিতে নেই। মূলত বর্তমানে দেশে ব্যবসায়িক পরিবেশ খুব বেশি ভালো না হওয়ায় এমন হচ্ছে। আগামী ছয় মাসে ব্যবসায়িক পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হবে, এমন সম্ভাবনাও দেখছি না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পূর্বাভাস বাস্তবে আসাটা খুব কঠিন।'
তবে ইস্ট কোস্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান তানজিল চৌধুরী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রাকে বাস্তবসম্মত বলে মনে করেন।
প্রথমত, তিনি মনে করেন, মারক্কিন শুল্কের সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবিলায় সরকার ও ব্যবসায়ীদের নেওয়া উদ্যোগে ইতিবাচক ফল আসবে—যা বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালোর দিকে নিয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, তানজিল আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার কমে যাওয়াকে সাময়িক পরিস্থিতি হিসেবে দেখছেন। তিনি আশা করছেন, সামনের দিনগুলোতে আমদানি বাড়বে—যার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, টাকার মান বাড়ায় তা অর্থনীতিকে চাঙা করবে বলে তার বিশ্বাস।
তৃতীয়ত, তানজিল বলেন, রপ্তানির আদেশ কমছে না। ফলে এখানে একটা ভালো সম্ভাবনা রয়ে গেছে। 'এই রপ্তানি খাতকে সামনে রেখে এগোলেই আমরা বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব বলে মনে করি।'