বীমা খাতে পরিবারতন্ত্র রোধ, গ্রাহকের স্বার্থরক্ষায় উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার

বাংলাদেশের বীমা শিল্প:
- মোট কোম্পানি: ৮২
- লাইফ বীমা কোম্পানি ৩৬টি
- নন-লাইফ বীমা কোম্পানি ৪৬টি
- বীমার আওতায় রয়েছে ১.৬৪৯ কোটি মানুষ
- ২০২৩ সালে গ্রস প্রিমিয়াম আয়: ১৮,২২৭ কোটি টাকা
- ২০২৩ সালে বীমা কোম্পানিগুলোর মোট সম্পদ: ৬৪,৬৪৬ কোটি টাকা
- ২০২৩ সালে লাইফ কোম্পানিগুলোতে বীমা দাবির পরিমাণ: ১২,০৫১ কোটি টাকা
- ২০২৩ সালে লাইফ কোম্পানির নিষ্পত্তিকৃত দাবির পরিমাণ : ৮,৭২৮ কোটি টাকা
- ২০২৩ সালে নন-লাইফ কোম্পানির বীমা দাবির পরিমাণ: ৩,২১৫ কোটি টাকা
- ২০২৩ সালে নন-লাইফ কোম্পানির নিষ্পত্তিকৃত দাবির পরিমাণ : ১,১৪২ কোটি টাকা
দেশের বীমা খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে বীমা আইন ২০১০-এ বড় ধরনের সংশোধনী আনতে যাচ্ছে সরকার। আইনটি সংশোধনের লক্ষ্য— বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে পরিবারতন্ত্র রোধ করে দুর্নীতি প্রতিরোধ, এবং বীমা গ্রাহক বা পলিসিধারীদের স্বার্থ রক্ষা।
প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো বীমা খাতে আমূল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। এতে পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক নিয়োগে কঠোর বিধান, পরিবারের মালিকানায় সীমা, এবং দেউলিয়া বা ব্যর্থ বীমা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ইতোমধ্যেই তাদের ওয়েবসাইটে অধ্যাদেশটির খসড়া প্রকাশ করেছে এবং জনমত আহ্বান করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা শেষে চূড়ান্ত করা হবে এই অধ্যাদেশ।
২০১০ সালে প্রণীত বিদ্যমান বীমা আইনে গুরুতর কিছু ঘাটতি রয়েছে—যেমন পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অপসারণ, বা প্রতারণা ও দেউলিয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে রিসিভার নিয়োগের কোনো বিধান নেই। একই পরিবারের কতজন বীমা কোম্পানির পরিচালক হতে পারবেন, কিংবা কতদিন সেই দায়িত্বে থাকতে পারবেন—এ সম্পর্কেও কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।
সাম্প্রতিক ব্যর্থতাগুলোয় উন্মোচিত হয়েছে বিধানগত ফাঁকফোকর
বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ৮২টি বীমা কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে—এর মধ্যে ৩৬টি জীবন বীমা এবং ৪৬টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি। তবে গ্রাহকের প্রিমিয়াম সরাসরি গ্রহণকারী জীবন বীমা কোম্পানিগুলো প্রতারণা ও দুর্নীতির জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে একাধিক কোম্পানি গ্রাহকের জমাকৃত অর্থ তথাকথিত বিনিয়োগের নামে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। এর ফলে ফারইস্ট ইসলামি লাইফ, গোল্ডেন লাইফ, সানলাইফ, বাইরা লাইফ, পদ্মা ইসলামি লাইফ এবং সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স—এই ছয়টি কোম্পানি গ্রাহকদের ৩,৭৩৬ কোটি টাকার দাবি পরিশোধে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। এসব কোম্পানির কিছু পরিচালক হয় আত্মগোপন করেছেন, অথবা বা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ বা ইডরা) চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম বলেন, "এই কোম্পানিগুলোর পরিচালকরা বিনিয়োগের নামে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। কোম্পানিগুলো এখন অনেকটা দেউলিয়া হওয়ার পথে। আমরা আইন সংশোধন করছি যাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয় এবং গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।"
খসড়া অধ্যাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—বীমা কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহককে অর্থ ফেরত দিতে রিসিভার নিয়োগের বিধান। ২০১০ সালের আইনে এই ক্ষমতা ছিল না।
এছাড়া, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা এবং সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিম অপসারণের এখতিয়ার দেওয়া হচ্ছে, যাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। উল্লেখ্য, ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইনের অধীনে এই ধরনের ক্ষমতা ইতোমধ্যেই বিদ্যমান।
পরিবারতন্ত্র ভাঙতে কঠোর বিধি: পরিচালক নিয়োগ ও মালিকানা সীমাবদ্ধ হচ্ছে
দেশের বীমা খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পরিবারভিত্তিক দখলদারিত্ব ও পরিচালনা বন্ধে খসড়া অধ্যাদেশে আনা হচ্ছে বড় পরিবর্তন। এর আওতায় কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা কোন পরিবার মিলে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার রাখতে পারবে না। পরিবার বলতে খসড়া অধ্যাদেশে স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন এবং জামাতা ও পুত্রবধুকে বোঝানো হয়েছে। গোপনে কেউ ১০ শতাংশের বাড়তি শেয়ার ধারণ করলে, কর্তৃপক্ষ তার শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে অন্যদের কাছে বিক্রি করতে পারবে। এক্ষেত্রে শেয়ারের ফেস ভ্যালু বা বাজারমূল্যের মধ্যে যেটি কম হয়— সেই দামে শেয়ারগুলো বিক্রি করবে ইডরা।
এ অধ্যাদেশে পরিচালনা পর্ষদে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ কমাতে একই পরিবারের সর্বোচ্চ দুইজন পরিচালক নিয়োগের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। কোম্পানির নিজস্ব গঠনতন্ত্র যা-ই বলুক, এ নিয়ম অমান্য করা যাবে না। পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ সকল পরিচালক নিয়োগে ইডরার আবশ্যিক অনুমোদন নিতে হবে।
নতুন খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, একই ব্যক্তি একই শ্রেণীর সর্বোচ্চ একটি বীমা কোম্পানির পরিচালক হতে পারবেন। পাশাপাশি, কোনো প্রতিষ্ঠান একাধিক পরিচালক নিয়োগ দিতে পারবে না, কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রক্সি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। বিদ্যমান আইনে এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই, যার ফলে সুবিধাভোগীদের একচ্ছত্র দখল গড়ে উঠেছে।
পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে খসড়া অধ্যাদেশে আরও কিছু ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এসব ধারায় বলা হয়েছে, বীমা কোম্পানির পরিচালক হতে হলে কমপক্ষে ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কোন ঋণ খেলাপি, ফৌজদারী অপরাধে দণ্ডিত হলে বা জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্য কোন অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলে তিনি পরিচালক হতে পারবেন না। কোন ব্যক্তির মালিকানাধীন কোন কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল হলে বা প্রতিষ্ঠানটি অবসায়িত হলে তিনিও কোন বীমা কোম্পানির পরিচালক হতে পারবেন না।
খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, বীমা কোম্পানিগুলোর সংঘবিধিতে যাই থাকুক না কেন, একটি বীমা কোম্পানিতে সর্বোচ্চ ২০ জন পরিচালক থাকতে পারবে। আর এই ২০ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৬ জন স্বতন্ত্র পরিচালক থাকতে হবে।
কোনো বীমা কোম্পানিতে পরিচালকের সংখ্যা ২০ জনের কম হলে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা মোট পরিচালক সংখ্যার কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ হতে হবে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত তালিকাভূক্ত পরিচালকদের মধ্য হতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে।
বিদ্যমান আইনে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধরণের সুনির্দিষ্ট কোন বিধান নেই।
আরও ক্ষমতা পাচ্ছে ইডরা
আইনের সংশোধনীতে ইডরার নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা বড় পরিসরে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। খসড়া অধ্যাদেশটি পাস হলে বীমা কোম্পানির অর্থায়নে গঠিত সাব-সিডিয়ারি কোম্পানি, ফাউন্ডেশন বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানও পরিদর্শন করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। বাধ্যতামূলক নির্দেশনা জারির ক্ষমতা পাবে। পলিসিহোল্ডারদের স্বার্থের পরিপন্থি মনে করলে কর্তৃপক্ষ ওই কোম্পানির নতুন প্রিমিয়াম গ্রহণ নিষিদ্ধ করতে পারবে এবং পলিসিহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় কর্তৃপক্ষ যেকোন আদেশ দিতে পারবে।
খসড়া অধ্যাদেশে নতুন একটি ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, কোন বীমা কোম্পানি তার সম্পদ বা বিনিয়োগ বন্ধক বা জামানত রেখে, কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার বা তাদের পরিবারের ব্যক্তিদের কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোন উৎস হতে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারবে না এবং অন্য কোন আর্থিক সুবিধা দিতে পারবে না।
খসড়ায় বলা হয়েছে, এই পরিবর্তনগুলো মূলত কোম্পানির সম্পদ অপব্যবহার রোধ এবং শক্তিশালী তদারকি নিশ্চিত করতেই আনা হয়েছে।
অধ্যাদেশটি পাস হলে বীমা কোম্পানির অর্থায়নে গঠিত সাব-সিডিয়ারি কোম্পানি, ফাউন্ডেশন বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানও পরিদর্শন করতে পারবে কর্তৃপক্ষ।
তবে এবিষয়ে মন্তব্যের জন্য বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাঈদ আহমেদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
গ্রাহকদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে তহবিল গঠন
খসড়া অধ্যাদেশে লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর পলিসি গ্রাহকদের ভবিষ্যৎ প্রাপ্যতা পূরণের জন্য পৃথক তহবিলে আলাদাভাবে অর্থ সংরক্ষণ করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এতে বেলা হয়েছে, লাইফ ও নন-লাইফ কোম্পানিগুলো প্রতিবছর প্রাপ্ত গ্রস প্রিমিয়াম হতে অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাদ দিয়ে—বাকি অর্থ এই তহবিলে জমা করবে।
এই তহবিলের অর্থ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিরাপদ ও লাভজনকখাতে বিনিয়োগ করতে হবে এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত আয়ও এই তহবিলে জমা হবে।
বীমা কোম্পানিগুলোর এজেন্টদের পারিশ্রমিক পুনঃনির্ধারণ করার কথাও বলা হয়েছে খসড়া অধ্যাদেশে। বর্তমানে কোন বীমা কোম্পানির এজেন্ট তার পারিশ্রমিক বাবদ প্রথম বছর পলিসি গ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া প্রিমিয়ামের ৩৫% এবং দ্বিতীয় বছর নবায়ন প্রিমিয়ামের ১০% এবং পরবর্তী বছরগুলোতে নবায়ন প্রিমিয়ামের ৫% পেয়ে থাকে।
প্রথম বছরের জন্য এটি সর্বোচ্চ ২৫%, দ্বিতীয় বছরের জন্য নবায়ন প্রিমিয়ামের ১৫% এবং পরবর্তী বছরগুলোর জন্য নবায়ণ প্রিমিয়ামের ৫% রাখা হয়েছে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশের বীমা খাত মোট ১৮ হাজার ২২৭ কোটি টাকা প্রিমিয়াম আয় করেছে, যেখানে মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৬৫ লাখ বাংলাদেশি কোনো না কোনো বীমা কভারেজের আওতায় রয়েছেন। ওই বছর জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মোট দাবি এসেছে ১২,০৫১ কোটি টাকা। তবে পরিশোধ হয়েছে মাত্র ৮,৭২৮ কোটি টাকা। নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো পেয়েছে ৩ হাজার ২১৫ কোটি টাকার দাবি, যার মধ্যে পরিশোধ হয়েছে মাত্র ১ হাজার ১৪২ কোটি টাকা।