শ্রম অভিবাসনে সংস্কার কি শুধু দু’টি লাউঞ্জ আর সেবায় সামান্য উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ?

বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য উচ্চ ব্যয় — যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ — গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্রে শ্রম অভিবাসন খাতে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এ সমস্যা স্বীকার করে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে (১৮ ডিসেম্বর) প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, কর্মসংস্থান ব্যয় কমাতে অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বাস্তবে বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ ভিসা ব্যবসা, নিয়োগসংস্থার সিন্ডিকেট ও বন্ধ বাজার পুনরায় চালুর মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতেও দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। তাদের আশঙ্কা, মালয়েশিয়ার কুখ্যাত নিয়োগ সিন্ডিকেট – যেটি অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতির মাধ্যমে অভিবাসন ব্যয় বাড়ানোর জন্য অভিযুক্ত – আবারও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সক্রিয় হচ্ছে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের প্রচেষ্টাগুলো— দুর্বল দৃষ্টিভঙ্গি, দুর্বল বাস্তবায়ন ও সরাসরি নির্বাচনী ম্যান্ডেটের অভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বেসরকারি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও অভিবাসন বিশ্লেষক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন সিকদার বলেন, "সিন্ডিকেট ভাঙতে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই। আগের সরকারের চেয়ে তাহলে কি পরিবর্তন এসেছে?"
তিনি আরও বলেন, "প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক পরিচিতির কারণে আমরা নতুন শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ার আশা করেছিলাম, কিন্তু বাস্তবে কিছু প্রতিশ্রুতি ছাড়া অগ্রগতি তেমন হয়নি।"
অভিবাসীদের জন্য লাউঞ্জ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রথম ঘোষণা দেয়, প্রবাসীদের জন্য ভিআইপি সেবার। এরপরে বিমানবন্দরে ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং ও কর্মীদের আচরণ কিছুটা উন্নত হলেও, উদ্যোগটি সীমিত পরিসরে বাস্তবায়িত হয়েছে।
প্রবাসী কর্মীদের জন্য সরকার দুটি সরকার দুটি লাউঞ্জ নির্মাণ করেছে: একটি টার্মিনালের ভেতরে বিশ্রামের জায়গা ও স্বল্পমূল্যে খাবারের সুবিধাসহ, অপরটি বহুতল পার্কিংয়ে।
তবে এসব নিয়ে বিদেশযাত্রীদের অভিজ্ঞতা মিশ্র। গত সপ্তাহে কানাডাগামী এক দম্পতি ১২ ঘণ্টা আগে পৌঁছে এসি না থাকায় পার্কিং লাউঞ্জে তীব্র গরমে অস্বস্তিতে পড়েন।
তাদের আত্মীয় মো. জহির বলেন, "সোফা ও মাদুর থাকলেও যথাযথ ভেন্টিলেশন বা এসি না থাকায় সেখানে অবস্থান করা কষ্টকর ছিল।" তিনি কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থাপনের পরামর্শ দেন।
এর বিপরীতে, টার্মিনালের অভ্যন্তরীণ লাউঞ্জ তুলনামূলক স্বস্তিকর। গত ২৭ এপ্রিল সেখানে গিয়ে বিদেশযামী কর্মীদের স্বস্তিতেই বসে থাকতে দেখা যায়। কুমিল্লার কাতারগামী কর্মী হোসেন আলী বলেন, "আগে খাবারে ৩০% ছাড় পেতাম না, এখন পাচ্ছি। ফ্রি ফোন ও ফটোকপির সুবিধাও আছে।"
বিদেশযাত্রার ব্যয় এখনো উচ্চ
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, গত ১৫ বছরে শ্রম অভিবাসনের বিভিন্ন প্রধান গন্তব্যগুলোতে— পাসপোর্ট, প্রশিক্ষণ, এজেন্সি ও সাব-এজেন্ট ফি মিলিয়ে অভিবাসন ব্যয় দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেড়েছে।
এই ব্যয় বৃদ্ধির জন্য মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অবৈধ সিন্ডিকেটের উত্থানকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যেমন ২০১৭ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, সিঙ্গাপুরে অভিবাসন ব্যয় সর্বোচ্চ ২ লাখ ৬২ হাজার ২৭০ টাকা নির্ধারণ করেছিল।
সৌদি আরবের জন্য সর্বোচ্চ ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, বাহরাইনের জন্য ৯৭,৭৮০ টাকা, সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য ১ লাখ ৭ হাজার ৭৮০ টাকা, কুয়েতের জন্য ১ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা এবং ওমান ও কাতারের জন্য ১ লাখ ৭৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
২০২১ সালে, সরকার মালয়েশিয়ার জন্য সর্বনিম্ন খরচ ৭৮,৯৯০ টাকা নির্ধারণ করে।
তবে খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশের স্বল্প দক্ষ শ্রমিকদের জন্য সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার এবং সিঙ্গাপুরের মতো প্রধান গন্তব্যে যাওয়ার খরচ ৪ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার মধ্যে রয়েছে। ২০০৮ সালের আগে এই খরচ ছিল ৮০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকার মধ্যে।
গত বছরের ডিসেম্বরে, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, "অভিবাসন খরচ কমানো আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কিছু (রিক্রুটিং) এজেন্সি যথাযথভাবে কাজ করছে, কিন্তু অনেকেই আছে শ্রমিকদের শোষণ করতে চায়। আমরা সাব-এজেন্টদের ভূমিকা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "অনেকেই ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে কর্ম ভিসা পায়, যা ভিসা বাণিজ্য বন্ধ করতে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তবে গন্তব্য দেশগুলোতে ভিসা বাণিজ্য বন্ধ করতে নীতি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।"
তিনি আরও যোগ করেন, "সরকারের মালিকানাধীন রিক্রুটিং এজেন্সি— বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডকে আরও সক্রিয় করতে কাজ চলছে। এতে বেসরকারি এজেন্সিগুলো তাদের খরচ কমাতে বাধ্য হবে।"
জালাল উদ্দিন সিকদার বলেন, "মধ্যস্থতাকারীদের সংখ্যা বাড়ানো অভিবাসন খরচ আরও বাড়িয়ে দেয়। খরচ কমানোর জন্য দালালদের স্বীকৃতি দেওয়া, বিদ্যমান শ্রম বাজারগুলো উন্মুক্ত করা, দক্ষতা উন্নত করা এবং বেকারত্বের চাপ কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।"
শ্রম অভিবাসন খাতে আনুষ্ঠানিক সংস্কার কমিশন না থাকলেও— প্রবাসীদের সমস্যাগুলো এ বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
প্রতিবেদনে প্রতি তিন মাস অন্তর স্বচ্ছভাবে অভিবাসন ব্যয়ের তালিকা প্রকাশ এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেন, এজেন্সিগুলো (বাড়তি) টাকা নিতে পারে, কারণ মানুষ তাদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ দেয়।
তিনি বলেন, "এখন ডোর -টু- ডোর লেনদেন মনিটর করা তো আর মানবিকভাবে সম্ভব নয়। যদি সবাই যা চাওয়া হয় তাই-ই পরিশোধ করে, তাহলে এজেন্সিগুলোরও খরচ কমানোর কোনো গরজ থাকে না।"
তবে অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, কিছু ক্ষেত্রে এজেন্সির লাইসেন্স বাতিলের ঘটনাও রয়েছে বলে জানান তিনি।
অবৈধ ভিসা বাণিজ্যের বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে সচিব বলেন, "যখনই কোনো এজেন্সি ধরা পড়ে, তখনই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে অসাধু ব্যক্তিরা সবখানেই থাকে, এমনকি গন্তব্য দেশগুলোতেও। ফলে একেবারেই তা বন্ধ করা কীভাবে সম্ভব?"
ফের সক্রিয় মালয়েশিয়া সিন্ডিকেট
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনিয়ম ও অবৈধ নিয়োগের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ থাকা মালয়েশিয়ান সিন্ডিকেট আবারও সক্রিয় হয়েছে।
অথচ গত বছরের জুন মাস থেকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে এসব কেলেঙ্কারির কারণেই।
রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চার সাবেক এমপির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে, যারা সিন্ডিকেটের সাথে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এরা হলেন — সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাবেক ফেনী এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এবং ঢাকার সাবেক এমপি বেনজীর আহমেদ।
তবে সিন্ডিকেটের মূল নেতৃত্বে থাকা রুহুল আমিন স্বপন এবং আমিনুল ইসলাম (আমিন নূর) এখনও আইনের আওতায় আসেননি।
রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা অভিযোগ করেছেন, এবার আওয়ামী লীগ নেতাদের পরিবর্তে অন্য রাজনৈতিক দলের সদস্যদের যুক্ত করে— নতুনভাবে এ সিন্ডিকেট গঠনের চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক জয়েন্ট সেক্রেটারি ফখরুল ইসলাম বলেন, "শ্রমিকদের পাঠাতে সিন্ডিকেটকে অর্থ প্রদান আমরা মেনে নেব না। যদি অন্তর্বর্তী সরকারও একই পথে হাঁটে, তাহলে আমরা কঠোর আন্দোলন করব।"
তিনি জানান, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সব রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য খুলে দেওয়ার দাবিতে— সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়েছে।
সিন্ডিকেটের পুনঃউত্থানের বিষয়ে সিনিয়র সচিব নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া বলেন, "আমাদের কাছে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। আমরা আশা করি, আগের পরিস্থিতি আর ফিরে আসবে না।"
তিনি আরও জানান, বর্তমানে মালয়েশিয়া সফটওয়্যার ভিত্তিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করছে এবং প্রক্রিয়াটি আরও শ্রমিকবান্ধব করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। "আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করছি এবং প্রয়োজনে সহায়তাও চাইতে পারি"- বলেন তিনি।
বিদেশে নিয়োগের সুযোগ সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা সম্পর্কে সিনিয়র সচিব বলেন, "আমরা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। একদিকে বন্ধ হওয়া শ্রম বাজারগুলো পুনরায় চালুর চেষ্টা চলছে, অন্যদিকে নতুন বাজার খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।"
এবিষয়ে উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের মন্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন ও বার্তা পাঠানো হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।